নির্ভার হয়ে ছিল শুভদীপ। হালকা। ফুরফুরে। মনে মনে হেসেছিল সে। এ জগতে প্রত্যেকেরই ভালবাসার মানুষ জুটে যায়। মা মাঝে মাঝে বলে, কোনও বেমানান নারী-পুরুষ দেখলেই বলে, যার যেথা মজে মন, কিবা হাড়ি কিবা ডােম।
তারা অতএব একটুও স্পর্শ না করে শুয়ে ছিল সারা রাত।
অব্যক্ত চিরবিচ্ছেদ লিখিত হয়েছিল দুজনের মধ্যে। সেই রাত্রেই। হাওড়া ইস্টিশানে নেমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার মুহূর্তে চন্দ্রাবলী তাকে বলে, অরুণেশ–তার চোখ দুটি সুন্দর জানিয়েছে। মেদ নয়, মাংস নয়, ত্বক নয়–ওই চোখে ডুবে,সুরেলা কন্ঠে চেপে কান, একটি সহজ মনের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে মন, জীবন কাটিয়ে দেবে অরুণেশ।
আর সেই রাত্রি থেকে তার অসহ্য কষ্ট শুরু হয়। অসহ্য যন্ত্রণা। কেউ যেন তার কোনও দেহাংশ কেটে নিয়ে গেছে। চন্দ্রাবলী আসবে না আর। চন্দ্রাবলী ডাকবেনা আর। গান শোনাবেনা। বলবেনা স্বপ্নের কথা। শুনবে না শুভদীপ যত কথা বলে। তার কষ্টে সান্ত্বনা হবে না। হতাশায় জ্বালবে আশার প্রদীপ। সে তখন কুঁকড়ে যায়। দাঁতে কামড়ে ছিঁড়ে নেয় ত্বক। নিজেকে দুমড়ে-মুচড়ে দলা পাকিয়ে ফেলে। সে টের পায় সুতীব্র আবেগ। সুতীব্র ভালবাসা। টের পায় এ বন্ধন ছিঁড়ে ফেলা অসম্ভব। পারবে না। পারবে না সে। চন্দ্রাবলীকে দেওয়া সমস্ত তার বুকে ফিরে ফিরে লাগে, আর সে, একা, এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে একা একা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়।
সে চেষ্টা করেছিল। সংযত হতে চেষ্টা করেছিল। এক দিন, দু’ দিন, তিন দিন। চতুর্থ দিন সে ভোরবেলা ছুটে যায়। চন্দ্রাবলীর বাসস্থানে ছুটে যায় আলুথালু, অবিন্যস্ত; আরক্ত চোখ। আর চন্দ্রাবলীকে দেখামাত্র সে প্রবল কান্নায় পড়ে। পারবে না সে। চন্দ্রাবলীকে ছেড়ে থাকতে পারবে না জানায়।
এবং চন্দ্রাবলী ফিরিয়ে দেয় তাকে। অসম্ভব পাথুরে নিমোহে ফিরিয়ে দেয়। এত নিরাবেগ, এত নিস্পৃহ সে কখনও ছিল না আগে।
সে যখন পাগলের মতো, কিংবা মাতালের মতো, কিংবা কঠিন রোগাক্রান্ত মানুষের মতো টলতে টলতে চলেছে তখন, কী মনে করে চন্দ্রাবলী ফিরে ডেকেছিল তাকে। বড় আশা নিয়ে সে ফিরে তাকিয়েছিল। চন্দ্রাবলী তখন তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ঘরে ফিরে যায়। এবং বেরিয়ে আসে কার্ড হাতে। অরুণেশের কার্ড। ঠিকানা ব্যাঙ্গালোর।
সেই থেকে ক্রুদ্ধ সে। সেই থেকে চন্দ্রাবলী ঠগ ও প্রবঞ্চক। প্রতারক ও মিথ্যেবাদী। সেই থেকে সে তাকে তীব্র ঘৃণা করে। এখন, সেই মেয়েটিকে তার বড় প্রয়োজন, সেই চন্দ্রাবলীকে বড় প্রয়োজন। মেদ নয়, মাংস নয়, ত্বক নয়, এমনকী সুরেলা কণ্ঠ ও সুন্দর চোখজোড়াও নয়। তার দরকার একটি সহজ মন। তার মনের সঙ্গে মিশিয়ে নেবার জন্য একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখা মন।
কিন্তু সে ঘৃণা করে। সে ঘৃণা করে তাকে। যে বলেছিল তাকে ছাড়া বাঁচবে না এবং অনায়াসে বাঁচবার পথ করেছে ভিন্নতাকে ঘৃণা করে। সেইদিন থেকে ঘৃণা করে। এবং নিজের একাকী অস্তিত্বের মৃত্যু অপেক্ষা করে নিরন্তর।
২২. রবিবার বলে আজ
রবিবার বলে আজ সে বেশি সময় থেকে গিয়েছিল হাসপাতালে। কাল ছেড়ে দেওয়া হবে বাবাকে। বাড়ি ফিরে সে অবাক হল। বিশ্বদীপ কাজে বেরোয়নি। শুয়ে আছে বিছানায়।
জ্বর নেই। এমনিই শুয়ে আছে কাজে না গিয়ে। অভিযোেগ করল মা। সে বিশ্বদীপের পাশে বসে কপালে হাত রাখে। জ্বর নেই সত্যি। কিছুক্ষণ আগেই ছেড়ে গেছে জ্বরটা। জানায় বিশ্বদীপ। এখনও সে তৈরি হয়ে বেরুতে পারত। কিন্তু বড় অবসন্ন বোধ করছে সে। প্রায় সাতদিন হল এইভাবে রাত্রে জ্বর এসে সকালে ছেড়ে যাচ্ছে। আর ক্রমশ দুর্বল করে দিচ্ছে তাকে। বলতে বলতে সে কাশে। কাশির দমকে চোখমুখ লাল হয়ে যায়, চোখ ভরে ওঠে জলে।
স্নান করে খেয়ে নেয় শুভদীপ। তারপর বিশ্বদীপকে নিয়ে সদা ভরসা ডাক্তারের কাছে যায়। আর তাকে পরীক্ষা করে ডাক্তারের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। কত দিন কাশি, কত দিন জ্বর ইত্যাদি বাঁধাধরা প্রশ্ন করে তিনি থুতু ও রক্তের পরীক্ষা লিখে দেন। সঙ্গে বুকের এক্স-রে।
ভয়ে শুভদীপের মেরুদণ্ডে শিরশিরানি লাগে। কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করে না। ডাক্তারের বাড়ি থেকে সে সরাসরি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে যাবার সংকল্প নেয়। দশ হাজার টাকার পুরোটা খরচ হয়নি। সে নিশ্চিন্ত বোধ করে। একটি রিকশায় উঠতে যাবার মুখে বিশ্বদীপের কাশির দমক লাগে। আবার। কাশতে কাশতে পেট চেপে উবু হয়ে বসে পড়ে সে রাস্তায়। গলা। থেকে একদলা থুতু ছিটকে আসে। আর বিশ্বদীপকে জড়িয়ে থাকতে থাকতে শুভদীপ দেখতে পায় থুতুর সঙ্গে বেরিয়ে এসেছে রক্ত।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না সে। শরীরে কাঁপুনিধরে যায়। প্রশ্ন করে কত দিন থেকে হয়েছে এমন। দু’দিন হল।বেলে বিশ্বদীপ। বাবাকে নিয়ে এত ব্যস্ত সবাই, তাই সে কিছুই বলেৰি জ্বর কমাবার ওষুধ খেয়েছে। কাশতে কাশতে তার গলা চিরে রক্ত বেরুচ্ছে—এমনই বিশ্বাস করে সে। আর শুভদীপ সেই বিশ্বাসকে আঁকষ্ট্রেধরতে চায়। প্রাণপণে চায় সমস্ত পরীক্ষার ফলাফল হোক শূন্য। হোর্ক নেতিবাচক।
বাড়িতে কিছুই বলে না তারা। রক্ত পরীক্ষা বা বুকের এক্স-রে করানোর কথাও বলে না। সারাক্ষণ নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে বিশ্বদীপ। সন্ধের পর শুভদীপ আবার বেরিয়ে পড়ে হাসপাতালের দিকে। আজ রাতে তার না থাকলেও চলত। তবু সে ঝুঁকি নেয় না। চাদর নিয়ে, বাবার খাবার নিয়ে রওনা দেয়। বড় চাপ তার ভিতরে। বড় যন্ত্রণা। কারওকে যদি বলতে পারত একটু। একটু ভাগ করে নিত সব। দেবনন্দনকে আগে বলত অনেক কিছু। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আর পারছে না। চন্দ্রাবলীর অনুপস্থিতি বড় বেশি করে বাজছে তার।