বন্ধ দ্বার। সবুজ রং করা। আর এই সবুজে কোনও ঔজ্জ্বল্য নেই। মরে যাওয়া ফ্যাকাশে সবুজ। মৃতদের জন্য মরে যাওয়া রং।
সে রং সম্পর্কে কোথাও কোনও অভিযোগের কথা ভাবে না। বরং একবার প্রাচীরের ওপর মাথা তুলে থাকা বৃক্ষশীর্ষদের দেখে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঢুকে থাকা অন্ধকার দেখে। এবং প্রবেশদ্বারের দিকে পিঠ করে অবশিষ্ট পৃথিবীর দিকে মুখ করে তাকায়। বহুতল বাড়িগুলির উচ্চতা চোখে পড়ে তার। চাকচিক্য চোখে পড়ে। জানালায় রকমারি পর্দা আর লৌহজালিকার বারান্দা। একটি বাড়ির সঙ্গে আরেকটি বাড়ির আয়তনের পার্থক্য ছাড়া আকৃতিগত বৈসাদৃশ্য কিছু নেই। প্রত্যেক বাড়িই যেন একজন স্থপতিরই পরিকল্পিত। অথবা স্থপতি বহু, কিন্তু তাদের শিল্পভাবনায় বৈচিত্র নেই, নতুনত্ব নেই। কোনও অদৃশ্য কারিগর তাদের উদ্ভাবনী শক্তিকে একই ছাঁচে ছাঁদে রকমে ঢালাঢলি করে থিতু হয়েছে। একেক বাড়িতে বসবাসকারী দশাধিক পরিবারের বসনকলা পৃথক করা যায় না। একেবারে ন্যাড়া ডালে কাকের বাসার মতো। তফাত শুধু বাড়িঘেরা চাকচিক্যে। বিজ্ঞাপনের রকমে ও বাহুল্যের তারতম্যে। বিজ্ঞাপন তার চোখে পড়ে। সে নিজে বিজ্ঞাপনের ব্যাপারি। ছোটখাটো বিজ্ঞাপন। পাঁচশো, হাজার, দু’হাজার, পাঁচ হাজার—সর্বোচ্চ দশ দশের শিকে ছিঁড়লে তার নিখুঁত প্রাপ্তি দুশো। অতএব তাকে বলা যেতে পারে বিজ্ঞাপনের ফিরিওলা। ব্যাপারি হল তারা যারা এইসব মেয়েদের বিজ্ঞাপনে নিয়ে আসে।
সে দেখে। বিজ্ঞাপনের মেয়েদের অপূর্ব দেহসৌষ্ঠব ও অর্ধনগ্নতা দেখে। কিছুক্ষণ দ্রব চোখে তাকায়। মুহূর্তে তিনটি শরীর তার চোখে ভেসে ওঠে। তিনটি নারীদেহ। এই দেহসমূহের সঙ্গে এই আঠাশ বছর বয়স পর্যন্ত সে যৌনভাবে সম্পর্কিত।
বিজ্ঞাপনের নারীটি আর সাত কিলো মেদসমৃদ্ধ হলে তার প্রথম নারী হতে পারে। প্রথম নারী—যে তাকে ভালবাসেনি এবং যে তাকে প্রথম যৌনতার স্বাদ দিয়েছিল। যে তাকে বেঁধেছিল মোহে এবং মোহভঙ্গে। এবং শেষ পর্যন্ত সেই নারী হয়ে দাঁড়ায় প্রতারক।
এরপর দ্বিতীয় নারী। তার প্রতি ছিল তীব্র টান। কী টান সে জানে না। কায়িক না বৌদ্ধিক সে জানে না। শুধু টান জানে। অলৌকিক অপ্রতিরোধ্য টান জানে। তার সঙ্গে খোলাখুলি পরিপূর্ণ যৌনতা সম্ভব হয়নি কখনও। হয়েছিল আংশিক। কর্মদপ্তরের একাকী নির্জনতায় কিংবা ফ্ল্যাটের নিষিদ্ধ অভিনিবেশে। সে বড় কৃপণ ছিল এইবেলা। কিংবা গভীর ছলনাময়ী। শুভদীপকে একদিন না দেখলে তার চলত না। একদিন স্পর্শ করতে না পারলে সে মধ্য রাত্রে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদত। অথচ এই স্পর্শমাধ্যমে সে কেবল উসকে দিত তাকে যেমন দখিনা বাতাস উসকে দেয় ধিকিধিকি দাবানল। উসকে দেয় আর আগুন প্রজ্বলিত হয়। প্রজ্বলিত হয় আর লেলিহান উন্মাদ আগুন ধ্বংস করে, গ্রাস করে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় স্নিগ্ধ, শ্যামল, নির্বিরোধী, পরহিতব্রতী, জ্ঞানী বনাঞ্চল। এবং এই জ্বালামুখী টান, এই উসকে দেওয়া টান একদিনে, মাত্র একদিনে, মাত্র এক মুহূর্তে ছিঁড়ে যেতে পারে—যেমন গিয়েছিল তার ও মহুলির।
এমন আংশিক প্রাপ্তি ঘটত বলেই প্রজ্বলিত অগ্নি তাকে উন্মত্ত করে দিত। তাকে বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যাবে না, ত্বকের গভীরে কতখানি দাহ নিয়ে সে চলে, ফেরে। এই দাহ এই উন্মাদনা সমেত সে পাগল-পাগল শেষ পর্যন্ত উপগত হয়, ঘৃণা নিয়ে নিরাবেগ উপগত হয় চন্দ্রাবলীতে। আর চন্দ্রাবলী খুলে খুলে দেয় নিজেকে। বার বার। নির্দ্বিধায়। আপন স্বপ্নে আপনি মশগুল হয়ে। ভাবে না। হিসেব কষে না। শুধু স্বপ্নের তীর ধরে গান গেয়ে-গেয়ে ফেরে। চন্দ্রাবলী। চন্দ্রাবলী মোটা। গোল। কালো। বেঁটে। সাধারণের চেয়েও সাধারণ অনাকর্ষণীয় চন্দ্রাবলী।
সেই অগ্নি সঞ্চার করা নারী, তাকে কি প্রতারুক বলা যায়? যায় না? যায় না? তা ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়।
আবার বমি পায় তার। আর বিবমিষা থেকে বাঁচতে সে বিজ্ঞাপনের নারীশরীর থেকে চোখ সরায়। অনুভব করে, রাস্তার এই পারে গোরস্থানের কাছটায় যে মৃত্যুর নৈঃশব্দ্য, অন্য পারে ভেঙে খানখান হয়ে আছে। জনগণের স্বৈর শব্দে, বিপণনের ছড়িয়ে পড়া রঙে, উদাত্ত গৃহগুলির অহংকারী গৃহস্থালিতে ছাপিয়ে বেড়াচ্ছে জীবন। যেন এই পথ পেরুলেই সে পৌঁছে যাবে মৃত্যু থেকে জীবনে।
কিন্তু জীবনবিমুখ সে। পথটুকু পেরিয়ে গেল না। শুধু অনুভব করল, ও-পারের আটতলা বাড়িটিও তার জীবনে ঢুকে বসে আছে। ওই বাড়ির মধ্যেকার সমস্ত অজানা সমেত তার এই বেঁচে থাকা। যেমন একজন মানুষের মনের ভিতরকার গাঢ় অজানা জড়িয়ে তৈরি হয় সম্পর্ক, বছরের পর বছর, আর ওইসব অজানা অজ্ঞাত রাশি নিয়ে মানুষে মানুষে শোয় পাশাপাশি, গলা জড়াজড়ি ঘুম দেয়, ভালবাসে, একজন হয়তো খুন করেছে সেদিন, একজন গোপনে গমন করেছিল অন্যজনে, দপ্তরে তহবিল তছরুপ করে ফিরে এল হয়তো কেউ, আর ভালবাসল ফিরে এসে, জানাল না এ ওকে কিছু আর ভালবাসল, ভালবাসে কিংবা ভালবাসা মাখিয়ে নিয়ে ঘৃণা করে প্রকৃতই, ঘৃণা করে আর বালিশের তলায়, তোশকের তলায় লুকিয়ে রাখে মিথ্যা। মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে পরস্পরের ঠোঁটে তুলে দেয় পবিত্র চুম্বন, ভানের ভিতর নারীর স্তনবৃন্তে মুখ রাখে পুরুষ আর উরুর ভাঁজে কৃতকর্ম সংগোপনে রেখে নারী দুই উরু উন্মোচিত করে দেয়।