এ প্রশ্নে শুভদীপের বুকের মধ্যে টনটন করেছিল কষ্টে। হঠাৎই তার চন্দ্রাবলীকে বড় করুণ লেগেছিল। মহুলিকে সে যা বলেছিল, কোনও সচেতন উপলব্ধি থেকে নয়। কিন্তু কোণার্কের সেই নির্জনতায়, ছোট ছোট ঝোপ ঠেলা পথে যেতে যেতে সে চন্দ্রাবলীর অসহায়তাকে প্রত্যক্ষ করেছিল সর্বাংশে। সে করুণা করেছিল। সম্পূর্ণ করুণা করেছিল এবং অতিথিনিবাসে ফিরে সে যৌনতার তাগিদে নগ্ন করেছিল চন্দ্রাবলীকে। মন্দিরের মৈথুন দৃশ্য সেও দেখেছিল আড়চোখে এবং মনে মনে উত্তেজিত ছিল।
উত্তেজনার অবসান হলে তারা নীরবে জানালার কাছে বসে এবং দেখতে পায় আকাশে হাজার তারার ঢাকাই বুটি। চন্দ্রাবলী আলো নিবিয়ে দেয়। এবং তার গা ঘেঁষে বসে। মৈথুন তার বিষণ্ণতা হরণ করেছে। সে তখন গুনগুন সুর সাধে আর হঠাৎ আকাশ থেকে খসে পড়া নক্ষত্র দেখতে পেয়ে প্রার্থনা করে। চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করে। এবং চোখ খুলে প্রসন্ন হাসিতে মুখ ভরিয়ে দেয়। শুভদীপের কাঁধে হাল চেপে আদুরে গলায় জানায়–ঝরে-পড়া নক্ষত্রের আছে মনৰ্ম্মামনা পূরণের শক্তি। য চাওয়া যায় তার কাছে, তাই পাওয়া যায়।
শুভদীপ বলতে উদ্যত হয়েছিল যে পতনশীল নক্ষত্র আসলে হাজার বছর আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া জড়বস্তু ছাড়া কিছু নয় কিন্তু, তার বলার আগেই আকাশে এক আশ্চর্য আলোর ফুলঝুরি ওঠে। এবং একের পর এক উঠতেই থাকে। নানা আকারের, নানা বর্ণের ফুলঝুরি। আতসবাজির ফুলঝুরিতে আকাশ ছেয়ে যায়। আর তারা দু’জন, গায়ে গা লাগিয়ে স্তব্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকে সেই আশ্চর্য সুন্দরের দিকে।
২১. চমকে উঠল সে
চমকে উঠল সে। তার পাঁজরে খোচা মেরেছে পাশের লোকটি। বিড়ি খাবে। তার দেশলাই চাই। দেশলাই রাখে না শুভদীপ, তার ধূমপানের অভ্যাস নেই।
সে পাশ ফিরে শোয় এবং চোখ বন্ধ করে। আর মানসে ভেসে ওঠে সমুদ্র। সুনীল সুবিস্তৃত সমুদ্র। দশমীর সকালে কোণার্কের সমুদ্রপারে গিয়েছিল তারা। কোণার্ক শহর থেকে অনেকটা পথ। তারা রিকশা নিয়েছিল। তার মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে বসেছিল পাশাপাশি সমুদ্রের বালুচরে।
কোণার্কের বেলাভূমি স্নানের উপযুক্ত নয়। তাই ভিড় কম। ছোট ছোট দোকান। মাঝে মাঝে শঙ্খধ্বনি তুলছে শঙ্খের ফিরিওয়ালা। আর তারা জলের দিকে চেয়ে বসে আছে। কী অসামান্য সমুদ্র! কী গভীর! কী নীল। বড় বড় ঢেউ উঠছে না, কিন্তু সমুদ্র নিজেই শুধু জলের অপার্থিব সৌন্দর্যে তাদের বিমুঢ় করে দিল। তার মনে হল, এ সৌন্দর্য অনুপম।
যত দূর চোখ যায় গাঢ় নীল জলরাশি। ফুঁসে উঠছে না। যেন চিরশান্ত। চিরতৃপ্ত। অতুলনীয় প্রসন্নতায় পৃথিবীর গভীরতমকে স্পর্শ করেছে। সংযত লহর তুলে দিগন্তে সুনীল আকাশকে ভালবেসে করেছে আলিঙ্গন।
কথার প্রয়োজন নেই, তারা স্তব্ধ হয়ে আছে। আর বহুক্ষণ পর চন্দ্রাবলী বলছে, এমন এই নীল যেন ঈশ্বর তাঁর বিপুল মসীপাত্র উপুড় করে ঢেলেছেন। এক সমুদ্র নীলে তিনি লিখে চলেছেন চিরকালের মহাকাব্য। এই লিখন ফুরোবার নয়। সমুদ্র থেকে যাবে। শুধু বদলে যাবে মানুষেরা। এক দল যাবে। আসবে আরেক দল। আর বার বার লিখিত হবে মানুষ।
সারাদিন সমুদ্রপারে থেকে বিকেলে ফিরেছিল তারা। বনপথ ধরে হেঁটে হেঁটে ফিরেছিল। শহরে ফিরে দেখেছিল বিসর্জনের শোভাযাত্রা চলেছে। কিছুক্ষণ শোভাযাত্রা দেখে তারা অতিথিনিবাসে ফিরে আসে। আর চন্দ্রাবলী তার মুখোমুখি হয়। প্রশ্ন করে, এবার কি তারা বিয়ে করতে পারে না? এভাবে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো, এই লোকভয়, এই মিথ্যাচার আর কত দিন?
সে তখন অন্যান্য বারের মতোই ধমকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল চন্দ্রাবলীকে। কিন্তু চন্দ্রাবলী থামেনি। সে তখন যুক্তির পর যুক্তির পর যুক্তি সাজাতে থাকে। সে বিচ্ছেদ পেয়ে গিয়েছে বলে, তার সঙ্গীত বিদ্যালয়ে আয় বাড়িয়েছে বলে, এত দিন এত ঘনিষ্ঠতার কথা, তার মা হওয়ার গভীর ইচ্ছার কথা বলে আর বিবাহকে অনিবার্য করে তুলতে চায়।
শুভদীপ তাদের গৃহে স্থান অকুলানের কথা বলে তখন। আর চন্দ্রাবলী বলে সে সানন্দে অপেক্ষা করবে সুসময়ের জন্য, শুধু তাদের বিবাহ নিবন্ধীকৃত হোক।
তখন শুভদীপ ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, হারিয়ে ফেলে সংযম। এত দিন সেকথা সে বলতে পারেনি, বলতে পারেনি যে মোটা বেঁটে, কালো, গোল, কদাকার মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে পারে না–তা-ই বলে ফেলে জোর গলায় বলে ফেলে এবং একটি বিপুল ক্রন্দনের জন্য অপেক্ষমাণ হয়ে যায়।
কিন্তু চন্দ্রাবলী ক্রন্দনে আশ্রয় নেয় না। মৃত মৎস্যের মতো স্তব্ধ, অপলক চেয়ে থাকে তার দিকে। তারপর শুকনো গলায়, ভাবলেশহীন, এক অরুণেশের কথা বলে। অরুণেশ তার সহপাঠী। ভালবেসেছিল তাকে প্রেম নয়। মাঠে-ঘাটে ঘোরাফেরা নয়। সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল যখন সে স্নাতকপাঠ শেষ করে ঘরে বসে, আর অরুণেশ স্নাতকোত্তর পর্ব ছাড়িয়ে গবেষণা শুরু করেছে। আপত্তির ছিল না কিছুই। শুধু অরুণেশ নমঃশূদ্র ছিল। বাবা রাজি হননি বিয়ে দিতে।
চাকরি নিয়ে রিয়াধে চলে গিয়েছিল, ফিরে এসেছে অরুণেশ। বিয়ে করেনি। কারণ তার সংকল্প ছিল অন্য কারওকে বিয়ে না করার।
সে তো অপেক্ষা করেই আছে এত কাল, তবু দ্বাদশীর সন্ধ্যা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে বলে এসেছে চন্দ্রাবলী। এবার অরুণেশুকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে আর কোনও বারণ রইল না। রইল না পিছুটান কোনও।