শুতে ইচ্ছা করে না তার। বসতেও ইচ্ছা করে না। সে তখন দু’পা ভাঁজ করে জানুতে চিবুক রাখে। আর তার মনে পড়ে যায়। সে এভাবে বসলে চন্দ্রাবলী বলত দুঃখী লাগে। দেখতে দুঃখী লাগে। গালে হাত দিলে বলত দুঃখী লাগে। কপালে বাহু রেখে শুলে বলত দুঃখী লাগে। চন্দ্রাবলী তাকে দুঃখী দেখতে পারত না। দুঃখী সহ্য করতে পারত না। সে সংসারের কথা বলতে বলতে বিষণ্ণ হয়ে গেলে তার চোখ জলে উপচে উঠত। ভরসা দিত। তারা দুজনে থাকবে যখন, সম্মিলিত চেষ্টায় সংসারের অবস্থা ফিরে আসবে। শেষবার যখন বেড়াতে গিয়েছিল তারা, তিন দিনের জন্য, কী হাসিখুশি ছিল সে প্রথম দুদিন। কোণার্কের সূর্যমন্দিরে গিয়ে মৈথুনের বহু প্রকাশ দেখেছিল অপলক।
কোণার্ক। পুজোর সময় চন্দ্রাবলীই বেশি করে যেতে চেয়েছিল। গানের ইস্কুলের ছুটি চলছিল। টিউশ্যনও ছিল না। আগে থেকে প্রস্তুত ছিল
বলে মনোমতো কোথাও যেতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত একমাত্র কোণার্কতেই তারা থাকার জায়গা পেয়ে যায়।
দুর্গাপূজা চলছিল তখন। ঢাকঢোল বাজছিল। চমৎকার সাজানোগোছানো অতিথিনিবাসে উঠেছিল তারা। অষ্টমীর সকালে পৌঁছেই স্নান সেরে নেয় চন্দ্রাবলী। তার হাতে নতুন পাজামা পাঞ্জাবি ধরিয়ে দেয়। আর সে স্নান সেরে এসে দেখে জানালার কাছে বসে আছে চন্দ্রাবলী। ভেজা চুল খুলে ছড়িয়ে দিয়েছে পিঠময়। আকাশি রঙের কালো পাড় শাড়ি পরেছে। ঘন নীল শরতের আকাশে চোখ রেখে গান গাইছে গুন গুন। ক্রিম পাউডার ক্লিপ সেফিটিপিন–সমস্ত সাজিয়েছে ড্রেসিং টেবিলে। ব্যাগপত্র ঢুকিয়ে দিয়েছে দেওয়াল আলমারিতে। ঘরে মৃদু সুগন্ধ ছড়িয়ে গিয়েছে। সে তখন চুল আঁচড়ে, চশমা পরে, চন্দ্রাবলীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে টান-টান। উঁচু মনে হয়নি কোল। ঘাড় টনটন করেনি।.শুতেশুতে কবে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। সে তখন চন্দ্রাবলীর হাতে হাত রাখে, আকাশের দিকে তাকায়। গাঢ় নীল আকাশ দেখে চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না। সে চন্দ্রাবলীকে দেখে। চন্দ্রাবলীর ভারী স্তন আলগোছে তার কপাল স্পর্শ করে যায়। তার শরীরে শিহরন লাগে। বাড়ির কথা তার মনে পড়ে না, সে যে মিথ্যে বলে এসেছে মাকে, মনে পড়ে না। বিত্তহীনতা মনে পড়ে না। প্রতিটি পয়সা হিসেব করে খরচ করতে হবে ভুলে যায় সে কথাও। সে চন্দ্রাবলীকে গান গাইতে বলে। চন্দ্রাবলী তার চশমা খুলে নেয়। তার কপাল চুম্বন করে। এবং গায়।
সুতল রহলু ম্যায় নিদ ভরি হো পিয়া দহলৈঁ জমায়।
চরণ বলকে অঞ্জন হে নৈনা লে লু গায়।
আসোঁ নিদিয়া ন আবৈ হো নহি তন অর্লসায়। পিয়াকে বচন প্রেম-সাগর হো চলু চলি হো নহয়।
–ঘুমে অচেতন হয়ে শুয়ে ছিলাম। প্রিয় আমাকে জাগিয়ে দিলেন। আমার চোখে লাগিয়ে নিয়েছি তাঁর চরণকমলের অঞ্জন। শরীরে আর আলস্য লাগবে না। ঘুম আসবে না আর। প্রিয়তমর কথা, সে যে প্রেমের সমূদ্র, আমি তারই মধ্যে অবগাহন করি।
জনম জনমকে পাপবা ছিনমেঁ ডারব ধোবায়।
যহি তনকে জগ দীপ কিয়ৌ প্রীত বতিয়া লগায় ॥
পাঁচ তত্ত্বকে তেল চুয়ায়ে ব্রহ্ম অগিনি জগায়।
প্রেম-পিয়ালা পিয়াইকে হো গিয়া পিয়া বৌরায় ॥
—জন্ম-জন্মান্তরের পাপ এক মুহূর্তে ধুয়ে ফেলব আমি। এ দেহকে করব জগতের দীপ। তাতে দেব প্রীতির সলতে। পঞ্চতত্ত্বের তেল দিয়ে ব্ৰহ্মাগ্নিতে জ্বালিয়ে নেব। আমাকে পেয়ালা ভরে প্রেমসুধা দিলেন প্রিয়তম এবং নিজেও মত্ত হয়ে পান করলেন।
বিরহ-অগিনি তন তলফৈ হো জিয় কছু ন সোহায় ॥
উচ অটারিয়া চঢ়ি বৈঠ লু হো জহঁ কাল ন জায়।
কহৈ কবীর চিচারিকে হো জম দেখ ডরায়।।
–বিরহের আগুনে দেহ জ্বলে-পুড়ে গেল। আর কিছুই ভাল লাগে। এমন উঁচু অট্টালিকার ওপর চড়ে বসেছি আমি, যেখানে কালের গতিও নেই। কবীর বলে, সেখানে আমার কাছে আসতে যমও সাহস পাচ্ছে না।
আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল সে। কখন সে চন্দ্রাবলীর মাথা নামিয়ে আনে নীচে আর ওষ্ঠে রাখে মুখ, কখন তার তার হাত চলে যায় স্তনে আর কালো পাড় আকাশি রঙের শাড়ি মাটিতে খসে পড়ে, কখন সে শয়ন করে শায়িত চন্দ্রাবলীর শরীরে এবং প্রবেশ করে সে জানে না। সে জানে, সেদিন ওই সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত্রি পর্যন্ত তারা সফল সঙ্গম করেছিল সাতবার কেমন করে সে জানে না। গোটা একটি দিন তারা কাটিয়ে দিয়েছিল আহারে, নিদ্রায় আর মৈথুনে। খুব খুশি ছিল চন্দ্রাবলী। খুব আনন্দিত।
পরদিন সকালে প্রসন্ন ঝকঝকে ভোরে সে টের পায় তার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে চন্দ্রাবলী। একমুঠো শিউলি ফুল হাতে। সে হঠাৎ চাপ বোধ করে। মনে হয় চন্দ্রাবলীর মাথা একটি হাতির মাথার মতো ভারী। সে চন্দ্রাবলীকে বুক থেকে সরে যেতে বলেচন্দ্রাবলী শোনে না। বরং হাসে। বরং নিবিড় হয় আরও। হাতের শিউলিফুল সে বিছানায় ছড়িয়ে দেয়। বলে ফুলশয্যা তাদের। বলে সারা শয্যাময় বিছানো শরৎ।
এই কাব্যিকতাকে তার বাহুল্য মনে হয়। আধিক্যতা মনে হয়। সে ঠেলে সরিয়ে দেয় চন্দ্রাবলীকে আর চন্দ্রাবলীর মাথা সজোরে খসে পড়ে। সে তখন তাকে অতিরিক্ত আদিখ্যেতা দেখাতে বারণ করে দেয়।
চন্দ্রাবলী চুপচাপ শুয়ে থাকে অনেকক্ষণ কথা বলে না। একটি দীর্ঘ নীরবতা তাদের মধ্যে বিরাজমান থাকে প্রায় সমস্ত দিন। প্রয়োজনীয় কথার বাইরে কথা হয় না। একবারও গুনগুন করে না চন্দ্রাবলী। শুধু পরিকল্পনা মতো তারা কোণার্কের সূর্যমন্দির দেখতে যায়। আর দেখতে দেখতে দু’জনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বহু জনসমাগমে আবিল কোণার্ক সূর্যমন্দিরের স্থির বৃহৎ রথের চাকার সামনে সে যখন চন্দ্রাবলীকে আবিষ্কার করে তখন সে একমনে দেখে যাচ্ছিল মিথুন-মূর্তি। তার চোখের পলক পড়ছিল না। মৈথুনের বহু বিচিত্র ভঙ্গির সামনে সে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। তার কানে যায়নি যুবকেরা কটু মন্তব্য করছে। দু’চারজন। মধ্যবয়স্ক লোক এসে দাঁড়াচ্ছে তার গা ঘেঁষে। সে তখন চন্দ্রাবলীর হাত ধরে টানে এবং মন্দিরপর্ব শেষ করে শহরের উপান্তে নির্জন পথে চলে যায়। চন্দ্রাবলী তখন অদ্ভুত প্রশ্ন করে। জানতে চায়, সে মরে গেলে শুভদীপ খুশি হবে কিনা।