বড় ডাক্তার শুধু নির্দেশ দিয়ে যান। আর কর্তব্যরত শিক্ষানবিশ ডাক্তাররা সারাদিনের ভরসা। বড় ডাক্তারের নির্দেশমতো তাঁরা কাজ করেন। সঙ্কটাপন্ন রোগীও তাঁরা সামলান। শুভদীপ একদিন দেখেছিল বাবার পাশের শয্যায় এক বৃদ্ধকে অক্সিজেনের নল পরাতে গিয়ে নাকাল হয়ে যাচ্ছেন এক শিক্ষানবিশ ডাক্তার। কফ, থুতু, মল, মূত্র, রক্ত ও রোগের এক বিচিত্র গন্ধ এই ঘরে। প্রায় গোটা হাসপাতাল জুড়ে।
বড় ডাক্তার রোগী দেখতে এলে হুড়োহুড়ি ঠেলাঠেলি পড়ে যায় রোগীর আত্মীয়দের মধ্যে। সে-ও সেই ঠেলাঠেলিতে শামিল হয়। নিজেকে তখন খুব ছোট, খুব অসহায় লাগে তার। বড় ডাক্তারবাবুর গাড়ি ঢুকছে। দেখলেই তারা প্রত্যেকে সন্ত্রস্ত। নিরাপদ দুরত্ব রেখে গাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রত্যেকের মুখ প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ কিন্তু আশঙ্কায় করুণ। যেন দেবতা নেমে অাসছেন সহস্রার হতে। বর দেবেন। একটুকরো করে প্রাণ ভিক্ষা দেবেন প্রত্যেককেই।
বড় ডাক্তার এই সমস্ত উপেক্ষা করে হেঁটে যান। মূল্যবান পরিপাটি পোশাক পরে হেঁটে যান। এই নোংরা, আবর্জনাময়, দুর্গন্ধে পুর্ণ হাসপাতালে ডাক্তারের মূল্যবান পোশাক বড় বেমানান লাগে।
এবং কিছুক্ষণ পর ডাক্তার আগের মতোই জনগণ উপেক্ষা করে গাড়ি চেপে চলে যান। তখন শিক্ষানবিশ ডাক্তাররা হাতে কাগজপত্র নিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসে। সার সার বেঞ্চ পাতা একটি ফাঁকা ঘর। অল্প আলো। আর রোগীর আত্মীয়রা ছুটোছুটি করে ওইসব ছোট ডাক্তারদের ঘিরে ফেলে। এ ওকে ঠেলে এগিয়ে যেতে চায়। ডাক্তাররা রোগীর নাম ধরে চিৎকার করেন। বাড়ির লোক এগিয়ে গেলে কী কী ওষুধ কিনতে হবে, কী কী পরীক্ষা করা হবে, তার জন্য কিছু করতে হবে কিনা বুঝিয়ে দেন। আর তখন রোগীর আত্মীয়দের চারপাশে ভিড় কত্রে থাকে বিভিন্ন রোগ নির্ণয় কেন্দ্র, সেবাকেন্দ্র ও ডাক্তারের দালালরা। কম খরচে চমৎকার চিকিৎসা . পাইয়ে দেবার লোভ দেখিয়ে বহু রোগী তারা হস্তগত করে।
বারো দিন পার হয়ে গেল তাদের। জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলছে বাবা এখন। খাবার নল খুলে দেওয়া হয়েছে। চামচে করে গলা-গলা খাবার খাইয়ে দিয়ে যাচ্ছে শুচু আর মা। শুয়ে শুয়ে শয্যাক্ষত হয়ে গিয়েছে বাবার। মা দেবনন্দনের সাহায্যে প্রতিদিন বাবাকে কাত করে ধরে, আর শুচু ওষুধ লাগিয়ে দেয়। আর দু’চার দিন কেটে গেলেই তারা বাবাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
আজ রাত্রে শুভদীপের থাকার কথা ছিল না। বিশ্বদীপ সুস্থ নেই বলে সে এসেছে। খুব কাশছে বিশ্বদীপ। সঙ্গে জ্বর। সে-ই তাই চলে এসেছে একেবারে। জরুরি বিভাগের সামনের চাতালে এখন চাদর বিছিয়ে শোবার পালা চলছে। রোগীর আত্মীয়-স্বজন সব। কারও ভাই, কারও বন্ধু, কারও বাবা, স্ত্রী, বোন। সম্পর্কের অমোঘ টানে ভূমিশয্যায় শুয়ে রাতের পর রাত কাটাচ্ছে তারা। শুচু একটা ফোলানো বালিশ দিয়েছে। সে বালিশে! দিচ্ছে যখন, দেখল, রোজকার মতো টিফিন বাক্স খুলে ভাত খাচ্ছে ছেলেটা। বাচ্চু। উনিশ কুড়ি বছর বয়স। আলাপ হয়েছিল একদিন। বাবার দুটো শয্যা পরে বাচ্চুর বাবা আছে। কী হয়েছে ভদ্রলোকের সে জানে না। বাচ্চু রোজ দু’বেলা আসে। রাতে আসে। সকালে চলে যায়। দুপুরে আসে বিকেলে চলে যায়। আর প্রত্যেক দিন, বাবাকে খাওয়ানোর পর উদ্বৃত্ত ভাত নিজে খায় বসে বসে।
গোটা ব্যাপারটা ভাবলে গা গুলিয়ে ওঠে তার। বা কি বাড়ি থেকে খেয়ে আসে না? আসে। সে জিজ্ঞেস করেছিল। তারপরেও সে এই ভাত খায়।
বাচ্চু হাসে তাকে দেখে। সেও হাসে। মুখের ভাত গলাধঃকরণ করে তার বাবা কেমন আছে জানতে চায়। সে মাথা নাড়ে। ভাল। আর সে না জিজ্ঞেস করতেই পরবর্তী গ্রাস মুখে তোলার আগে সে জানিয়ে দেয়–তার বাবাও আছে। ভাল।
সে তখন বালিশের নীচে ব্যাগ বিছিয়ে নেয় এবং অন্য অনেকের সঙ্গে গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। আর শোবার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পায় ফোনবুথের আলো। এস টি ডি, আই এস ডি, পি সি ওঁ তার চোখের সামনে দুলতে থাকে। একটি দুর্দম ইচ্ছে তাকে অধিকার করে নেয়। সে ব্যাগ থেকে বার করে নেয় কার্ড। কত বার এই ইচ্ছে হয়েছে তার। কত বার। আর সে এরকম ভাবেই এই কার্ড বার করেছে। হাতে নিয়ে নিয়ে ময়লা হয়ে গেছে দিকে। ফুলীকে ঘৃণা কাবলী প্রবঞ্চক চারপাশ। রাগে কার্ডসমেত মুঠো পাকিয়েছে বলে ফাটল ধরে গেছে। এবং মুখস্থ হয়ে গেছে। তবুও সে আবার দেখছে। নাম দেখছে। কৃতিত্ব দেখছে। এবং ঢুকিয়ে রেখে দিচ্ছে। তার মনে পড়ে যাচ্ছে শেষ সাক্ষাৎ। চন্দ্রাবলীর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ এবং শেষ ভ্রমণ। আর কখনও তারা একসঙ্গে কোথাও যাবে না। তাদের যৌথ পরিক্রমা শেষ হয়ে গেছে। কেন গেছে? কার জন্য? চন্দ্রাবলীর জন্য। চন্দ্রাবলী ঠগ। চন্দ্রাবলী প্রবঞ্চক। মিথ্যক। কদাকার এবং কদাচারী। সে চন্দ্রাবলীকে ঘৃণা করে। তীব্রভাবে ঘৃণা করে। সে ঘৃণা করে মালবিকাদিকে। ঘৃণা করে মহুলিকে। সে যে ঘোষণা করেছিল মহুলিকে ভালবাসে–সে ছিল বিভ্রম। সে যে মহুলির ছবি রাখত সঙ্গে
সে ছিল মোহ। এখন মোহ কেটে গেছে তার। বিভ্রম ঘুচে গেছে। সে একটিই মাত্র নারীকে জানে। একমাত্র সৎ নারী। একমাত্র নিরপেক্ষ আশ্রয়। তার ক্রোড়ে কোনও পক্ষাবলম্বন থাকে না, থাকে না কোনও প্রতারণা। সে হাসপাতালের বিচিত্র জনমণ্ডলীর মধ্যে শুয়ে, বিচিত্র গন্ধ ও শব্দসমূহের মধ্যে, নিরন্তর জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে শুয়ে সেই নারীকে কল্পনা করার প্রয়াস নেয়, তার কাছে পৌঁছনোর উপায় ভাবতে থাকে কিন্তু মন লাগে না। অতি আকাঙিক্ষত, অতি প্রিয় মৃত্যুতেও মন লাগে না। সমস্ত বাধা ঠেলে, বিরুদ্ধতা ঠেলে টেলিফোন যন্ত্রের কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করে। দূরভাষে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে আহ্বান। দূরে, দূরান্তরে। কত দুর সে জায়গা? সে উঠে বসে। ব্যাগ থেকে জলের বোতল নিয়ে জল খায়। নিঝুম হয়ে আসছে হাসপাতাল। যদিও শ্মশানের মতো এখানেও ঘুম নামে না সর্বত্র, আলো নেবে না।