পরিশ্রমের উপযুক্ত বয়সে পরিশ্রম করছে অতএব বিশ্বদীপ। সকাল সাতটায় বেরিয়ে যায় কারণ ঘরে ঘরে বাবু ও বিবিরা তখন উপস্থিত থাকেন। তাকে গ্রহণ করা বা বিতাড়ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া তাদের পক্ষে সহজ হয়। সেইভাবে দেখতে গেলে জনগণ অত্যন্ত দয়ালু। তাদের দেখার বা শোনার সময় নেই। তবু কয়েকজন সময়ের থেকে সময় রাহাজানি করে তাকে সুযোগ দিয়েছেন। অন্তত বলার সুর্যোগ। দশটা বাড়ি ঘুরলে একটা বাড়িতে বিক্রি। বাকি সব বাড়িতে সকালে সময় নেই কারণ আপিস যাবার তাড়া। দুপুরে সময় নেই দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত। বিকেলে সময় নেই ইস্কুলফেরত আপিস-ফেরতদের জন্য খাবার-দাবারের ব্যস্ততা। সন্ধের পর থেকে তো হরেক কাজ।
পৃথিবীতে মানুষের কাজের কোনও শেষ নেই। তারও নেই প্রচেষ্টার শেষ। সপ্তাহে তিনদিন বিশ্বদীপ সকাল সাতটায় বেরিয়ে সন্ধে সাতটায় ফিরে আসে। তারপর পড়াতে যায়। বাকি চারদিন সে বেরোয় একই সময়, কিন্তু ফিরে আসে রাত দশটায়। লক্ষ্যমাত্রা অভিমুখে সারাদিন ছুটে ছুটে ক্লান্ত। তার কোনও রবিবার নেই।
সেদিক থেকে বরং পাঁচ টাকার হরেক মাল ফিরিওয়ালাদের সুবিধে, পথ দিয়ে বোঝা সঙ্গে করে তারা হেঁকে যায়। তাদের টানা স্বরে পাড়ায় পাড়ায় উদাসী আবহ তৈরি হয়। যার প্রয়োজন, ডেকে নেয় তাকে। দোরে দোরে ঘুরে বেড়ারার দায় নেই তার। পকেটে কানাকড়ি, এদিকে ঝলমলে পোশাক পরে সংস্থার মান রাখার দায় নেই।
ঝলমলে পোশাক। কাজে যোেগ দেবার সময় বিশ্বদীপের এই ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। তখন দেবনন্দন সব সমাধান করে দেয়। ছোট শ্যালক হিসেবে বিশ্বদীপকে সে উপহার দেয় দু’প্রস্ত মূল্যবান পোশাক।
দেবনন্দন! দেবনন্দন। তার আশৈশবের বন্ধু। তার বোনের স্বামী। দেবনন্দন। সে দেবনন্দনকে আজ খারাপ পাড়ায় দেখেছে।
খারাপ পাড়া কেন? সে জানে না। ভাবেনি কখনও। লোকে বলে। সেও বলছে। চোর, ছাচোড়, অসৎ, ভণ্ড, প্রবঞ্চক, মিথ্যেবাদী গিস-গিস করা এই সব ভদ্রপাড়া ভাল পাড়া। আর ও পাড়া হল খারাপ পাড়া। সে আজ খারাপ পাড়ায় দেবনন্দনকে দেখেছে। আর দেখামাত্র, যাতে,তাদের চোখাচোখি হয়ে না যায়, সে পালিয়ে এসেছে দ্রুত পায়ে।
কেন গিয়েছিল দেবনন্দন? কখন গিয়েছিল? কবে থেকে যায়? সে তো জানেনি কোনও দিন। শোনেনি তো! আশৈশব বন্ধু তার, একসঙ্গে দেখতে শুরু করেছিল ন্যাংটো মেয়ের ছবি, আজ কত দূরে চলে গিয়েছে পরস্পর?
নে গিয়েছিল দেবনন্দন? কেন?
সে মরে গেলেও এ কথা শুচুকে বলতে পারবে না। জানতে চাইতে পারবেনা, শুচু,নীলচে রোগী শুচু, যৌনতায় অপারঙ্গম কিনা। সে এ কথা বলতে পারবে না এমনকী বিশ্বদীপকেও। তা হলে কাকে বলবে? কার সঙ্গে আলোচনা করবে এর ভয়াবহতা নিয়ে? কাকে বলতে পারত?
চন্দ্রাবলীর মুখ তার মনে পড়ে। চন্দ্রাবলীকে সব বলা যেত। সব।
সে ছটফট করে। এপাশ ওপাশ করে। ঘুম কামনা করে কিন্তু ঘুম আসে। চন্দ্রাবলী, শুচু, দেবনন্দন, সমাধিক্ষেত্র, পাপ, পুণ্য, জীবন-মৃত্যু তাকে ঘিরে ঘুরপাক খায়। মা, বিশ্বদীপ, মহুলি, মালবিকা, চম্পা একসঙ্গে হাত পা নেড়ে কথা বলে। সে পরিষ্কার দেখতে পায় সেই কুয়ো, যার মধ্যে মৃতদেহ শুয়ে আছে। সেই জন লোকটাকে দেখতে পায় যে সমাধিক্ষেত্র পাহারা দেয়, সারাদিন সমস্ত জায়গাটা ঘুরে বেড়ানো ছাড়া যার কাজ শুধু কুকুরকে খাওয়ানো। তার পাশে নির্বিকার এসে দাঁড়ায় মেয়েদের মতো ছেলেটা। আর পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যায় যিশু যিশু বলতে বলতে আলোকবর্তিকা হাতে পুরুষ। আর আসে একটি সাপ। বিশাল কালো সাপ। মুহূর্তে সে সাদা হয়ে যায়। মুহূর্তে কালো। আর এক চতুর্দশীকে ঘিরে পাক খায়। পাক খেতে থাকে। আর সে, অবাক হয়ে দেখে সেই চতুর্দশী শুচু। শুচু চিকার করে। শুভদীপ বলে চিৎকার করে। অতঃপর শুভদীপ শুভ হয়ে যায়। বিশ্ব হয়ে যায়। শুভ শুভ বিশ্ব বিশ্ব…।
সে ধড়ফড় করে উঠে বসে। মা ডাকছে। তাড়াতাড়ি যেতে বলছে তাদের। বাবা কেমন যেন করছে। কীরকম করছে? কীরকম? সে ভাইকে ঠেলছে। ভাই উঠছে না। উঠতেই চাইছে না। সমস্ত শরীর জুড়ে এক মহাসমুদ্র ঘুম তাকে জড়িয়ে আছে। সে তখন ঝাঁকানি দেয় ভাইকে আর ভাই ঘোর ভেঙে, ঘুম তাড়িয়ে আরক্ত চোখে উঠে বসে। ভাইকে বাবার অসুস্থতার সংবাদ দিয়ে পাশের ঘরে যায় সে।
দৃষ্টিহীন চোখে শুয়ে আছে বাবা। মুখের ডান পাশ বাঁকা লাগছে, স্থির, নিস্পন্দ। কিন্তু বুক উঠছেনামছে। সে বাবার পায়ে হাত দেয়া বরফশীতল পা। বিশ্বদীপও এসে দাঁড়ায় তখন। সে ডাক্তার ডাকতে যাবার জন্য তৈরি হয়। বিশ্বদীপও সঙ্গে সঙ্গে আসে। দু’জনে মিলে ভুটতে থাকে ডাক্তারের বাড়ি। দরজায় ঘন্টি বাজায় একযোগে, একযোগে কড়া নাড়ে। একযোগে ডাক্তারের নাম ধরে চিৎকার করে। এক মিনিট, দুমিনিট, তিন মিনিট, চার মিনিট পাঁচ মিনিটের মাথায় ডাক্তারের তিনতলার জানালা খুলে যায়। তারা একসঙ্গে ওপরের দিকে মুখ তোলে। পরিবেশন করে বাবার অসুস্থতার সংবাদ। পাড়ার চেনাশোনা সদাসম্বল ডাক্তার লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে নেমে আসেন নীচে। তারা তাঁকে বাড়ি যাবার জন্য অনুরোধ করে। তিনি আরও তিন মিনিট ব্যয় করে গেঞ্জির ওপর পাঞ্জাবি চাপিয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে আসেন। বিশ্বদীপ তাঁর হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নেয়। এবং বাবাকে পরীক্ষা করেই তিনি হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। একটুও সময় নষ্ট না করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাসপাতাল।