বুকের ওপর যে গলা, তার সঙ্গে বুকের টানাটানি, আর গলার ওপর যে বড় গোলাটে মুখ—সেই মুখের সঙ্গে টানাটানি এই মহাবিশ্বের ত্রিমাত্রিক শূন্যতার–যার অনেকটাই সে দখল করে নেয়। আর মহাবিশ্বের আরও বহু বস্তুর প্রতিযোগী হয়ে ওঠা মুখমণ্ডলে তারও আছে একজোড়পুরু ঠোঁট ও চাপা নাক। নাকের ওপর একজোড়া বড় বড় চোখ, চোখের ওপর কৃশ, দীর্ঘাঙ্গি ভুরু। ভ্র ছাড়িয়ে ছোট কপালের ওপর এসে পড়া অলকচূর্ণ, তার রাশিকৃত, ঘন, দীর্ঘ চুল থেকে এসে পড়া।
শুভদীপ যেদিন প্রথম তার সঙ্গে রাত্রিবাস করে, হঠাৎ ঘটে-যাওয়া ঘটনাবশত রাত্রিবাস করে, সেদিন স্নান-শেষেঅতিথি-নিবাসের জোড়া বিছানার একটিতে সে শুয়ে ছিল চুল এলায়িত করে। দেহ তার দেহবল্লরী নয়। বরং দেহগাছা। বা দেহবৃক্ষ। সেই দেহবৃক্ষ মেলে, চুল এলিয়ে, চোখ বন্ধ করে সে শুয়েছিল সেদিন। তারা চলেছিল রায়মাটাং বনে। সেখানে রবিদা আগেই একটি দল নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তারা সেই দলে যোগ দিতে যাচ্ছিল। পথে রেলগাড়ির লাইনচ্যুতি হয়, তারা একটি বড় দুর্ঘটনার হাত থেকে রেহাই পায়। কিষাণগঞ্জ ইস্টিশান থেকে তারা শিলিগুড়িগামী একটি ছোট রেলে চাপে। এবং শিলিগুড়ি পৌঁছয় সন্ধে নাগাদ। দূরপাল্লার সমস্ত বাস তখন চলে গিয়েছে। ইন্টার সিটি নামের রেলগাড়িটিও ত্যাগ করেছে ইস্টিশান। অতএব তারা তখন একটি অতিথি নিবাসে যায় এবং একটিমাত্রই ঘর নিয়ে ফেলে। সেই ঘরে চন্দ্রাবলী স্নান সেরে, চুল এলায়িত করে, দেহবৃক্ষ টান-টান, চোখ বন্ধ চোখ, চক্ষু, নয়ন, লোচন, আঁখি, দৃকপাত যন্ত্র-চন্দ্রাবলীর শরীরের একমাত্র সুন্দর অঙ্গ। যদিও সে লক্ষ করেনি। জানেনি কখনও। দেখেনি কোনও দিন। দেখেনি আলাদা ভাবে, দেখার মতো করে। তারও যে শরীরের কোথাও, কোনও এক অঙ্গে সৌন্দর্য মাখা ছিল। সেই অঙ্গ চোখ। সেই চোখ বড় কিন্তু হরিণচঞ্চল নয়। অতলস্পর্শী গভীর। গভীর চোখের মতো বেদনার করুণ ভাষাসংবলিত স্থির ও শান্ত মূক ও ভীত। দেখেনি সে প্রথম দিন। দ্বিতীয় দিন। এমনকী শেষ দিনও। চন্দ্রাবলীর কোনও কিছুই সে দেখেনি, খোঁজেনি, বুঝতে চায়নি। চন্দ্রাবলীর জন্য সে এতটুকু ক্লেশ সইবার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। বস্তুতপক্ষে চন্দ্রাবলী ছিল তার কাছে যেচে-আসা, ডানা-মুচড়ানো পাখি। সে ছিল স্বয়মাগতা। সে ছিল বাধ্য। আত্মনিবেদিত। শুভদীপ তাকে চায়নি। কখনও চায়নি। বরং ঘৃণা করেছে ওই পুরু ঠোঁট, চাপা নাক, কালো রং এবং থাক থাক চর্বি। তার নিজের ছিপছিপে ঋজু নির্মেদ শরীবর পাশে ওই পৃথুল শরীরকে সে ঘৃণাই করেছে বারবার।
একটি গোরস্থানের সামনে এসে দাঁড়াল সে। শহরের বড় বড় গোরস্থানের একটি। ইসলামে দীক্ষিত মানুষদের এখানে গোর দেওয়া হয়। গোর দেওয়া হয় কখন? মৃত্যুর পর। মরে গেলে। প্রাণহীন দেহফিরিয়ে দেওয়া হয় মাটির কাছে। মাটির বস্তু মাটিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আর এই প্রত্যর্পণের মধ্যে জেগে থাকে মৃত্যু।
সেই জাগ্রত মৃত্যুকে স্পর্শ করার বাসনায়, সে শুভদীপ, গোরস্থানের প্রাচীর স্পর্শ করল একবার। তাকাল ওপরের দিকে। উঁচু প্রাচীরের সীমানা ছাড়িয়ে বড় বড় গাছের উদাত্ত ডালপালা। সবুজ পাতায় ভরা। এখন যে যথেষ্ট বিকেল তার আলো এসে ভরে আছে বৃক্ষশীর্ষে। তবু, তার মনে হয়, ওই সবুজে লেগে আছে কিছু অন্ধকার, কিছু কিছু গাম্ভীর্য। বিষণ্ণতা নয়, বরং অনিবার্য পরিণতির বিষয়ে জ্ঞানগম্ভীর ঔদাস্য।
সে নিজের অশান্ত বুকে হাত রাখে। অস্থির মস্তিষ্কের ওপরকার খুলিতে হাত বোলায়। তারপর, শান্তির সন্ধানে, কিংবা মৃত্যুর সন্ধানে, কিংবা মৃত্যুর উদাস নিরপেক্ষ গাম্ভীর্যকে আত্মস্থ করার অভিপ্রায়ে সে এগোয়। খুঁজতে থাকে প্রবেশদ্বার।
তার যাবার কথা ছিল একটি ভ্রমণ সংস্থায়। সেখানে গেলে কিছু বিজ্ঞাপন পাওয়া যেত। বিজ্ঞাপনের মূল্য থেকে দুই শতাংশ তার মাসিক আয়ে যোগ হতে পারত। যোগ হলে, সংসারের হাঁ-মুখ চুল্লিতে, কিছু জ্বালানি যোগানো যেত। যোগালে মায়ের অভিযোগ কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ থাকত।
মায়ের অভিযোগ। মা। সে একবার থমকে দাঁড়ায়। তার কিছু মনে পড়ার কথা, অথচ মনে পড়ে না। পরিবর্তে মায়ের মুখ। ক্লান্ত, হতাশ, স্থিতিশীল বিরক্তি-ভরা মুখ। এ-মুখে সেই প্রসন্নতা আর নেই যা সে দেখেছে ছোটবেলায় আর নিরন্তর অধিকার করেছে বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। বড় হয়েছে সে। আর বড় হতে-হতে, বড় হতে-হতে প্রাক ত্রিশে পৌঁছবার পর চোখ খুললেই দেখতে পাচ্ছে মায়ের প্রসন্নতার ওপর কাল ও পরিস্থিতির সমুচ্চ প্রলেপ। মা এখন সংসারের হাঁ-মুখ অন্ধকার ছাড়া জানে না কিছুই। ইনিয়ে-বিনিয়ে দুঃখ কষ্ট সমুদ্ধার ছাড়া, অভাবের দৈনন্দিন অভিযোগ এবং জীবনে কিছুই না পাবার উচ্চকিত ঘোষণা ছাড়া আর কিছু জানে না। আর কিছু আছে কি? শুভদীপ ভাবে একবার। দুঃখের নিবিড় বসতি ছাড়া আর কিছু আছে কি সংসারে?
সহসা তার মনে পড়ে যায় যা-কিছু মনে পড়ার কথা। দরজা। গোরস্থানের দরজা। যা সে খুঁজছিল এতক্ষণ এবং তৎক্ষণাৎ মা অন্তর্হিত হয়ে যায় মন থেকে। বরং বেশি করে মনে পড়ে চন্দ্রাবলী। চন্দ্রাবলী আর মৃত্যুর ঔদাস্য। মৃত্যুর ঔদাস্য আর এই বিকেল। বিকেলের আলো বৃক্ষশীর্ষ থেকে গড়িয়ে পড়েছে প্রবেশদ্বারে আর বিছিয়ে গিয়েছে ভূমিতেও। যেন এই আলো এক ভূমিসূতা। যখন সে জলে নামে আর হয়ে যায় জলকন্যা, তার থেকে এখন রকম আলাদা। সে এখন অপেক্ষা করে আছে কখন এসে যায় এক মৃতদেহ আর তাকে মাড়িয়ে শববাহকেরা বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। বন্ধ দ্বার খুলে যাবে তখন। আর সে তৃপ্ত হবে। ভূমিসূতা, ভূমিশায়িতা আলোর টুকরো।