সেই জুতো আজ ছিঁড়ে যাচ্ছে। ফেটে যাচ্ছে। চন্দ্রাবলীর উপহার দেওয়া জুতো। জুতো কি কেউ কারওকে উপহার দেয়? শুভদীপ আকাশের দিকে তাকায়। জুতো কেউ কারওকে উপহার দেয় না। জুতো চন্দ্রাবলী উপহার দেয়নি। জুতো কেউ কারওকে কিনে দেয়। তারা যখন ছোট ছিল–সে, দীপান্বিতা, বিশ্বদীপ–তাদের বাবা পুজোর আগে আগে তাদের সামনে বিছিয়ে দিত একটি বিশাল খবরের কাগজ। বিশাল কাগজ। খুব বড়। যেন আকাশের মতো। সেই আকাশ নানা ঢঙের জুতোয় ভর্তি। তারা তিনজন প্রায় চড়ে বসত সেই কাগজে। আর কাগজটা মন্ত্রপূত কার্পেট হয়ে যেত তখন। শোঁ-শোঁ করে উড়তে উড়তে, হাওয়ায় উড়তে উড়তে, তারা তিন ভাইবোন জুতোপছন্দ করত। এইটা না এইটা না এইটা। কোনটা? কোনটা? ওইটা। সে যেটা দেখাত, বিশ্বদীপও দেখাত সেটাই। আর দীপান্বিতা শুচু হয়ে বেছে নিত মেয়েদের জুতো। বাবা, ওই জাদু কার্পেট গুটিয়ে তাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। তারা তখন কলরব করতে করতে জুতোর দোকানে চলল। একদিন জুতোর জন্য বেরুনো, একদিন পোশাকের জন্য। আর সেই দুদিন রেস্তোরাঁয় খাওয়া মায়ের জন্য বাক্সয় পুরে নিয়ে আসা। সব কিছুই।
বাড়ি থেকে তারা বাবার সঙ্গে বেরোয় অপরূপ শৃঙ্খলায়। বাবার হাত ধরে শুচু, বাবার হাত ধরে বিশ্বদীপ। আর সে বিশ্বদীপের হাত ধরে। মা দাঁড়িয়ে দরজায়। পুরনো বাড়িটার ইটগুলি অতখানি বিবর্ণ ছিল না তখন। অতখানি বিষণ্ণতা ছিল না খাঁজে খাঁজে। মায়ের কানের লতি কেটে দুলজোড়া পতনোম্মুখ হয়নি তখনও। মা দরজায় দাঁড়িয়ে সাধারণ করে শাড়ি পরা। মাথায় ঘোমটা। ফর্সা, ছোটখাটো মা। বড় বড় চোখ। হাসিহাসি মুখ। প্রসাধন নেই, তবু কী সুন্দর!
মা যাবে না। মা থাকবে। তাদের জন্য সুজি করে রাখবে। জলখাবার। তারা বাড়ি ফিরে সমস্বরে বলবে কী কী খেল, আর দেখল কী কী। মা হাসিমুখে সব শুনতে থাকবে। শুচু কেনা বস্তুসম্ভারের মোড়ক খুলে খুলে সাজিয়ে রাখবে বিছানায়। মা দেখার জন্য এগিয়ে আসবে আর বলতে থাকবে কত কী সে করে রেখেছিল ছেলেমেয়েদের জন্য। বাবা তখন খাবারের বাক্স মায়ের হাতে ধরিয়ে দেবে। মা সলজ্জ হেসে, ঘোমটা একটু টেনে, জানিয়ে দেবে, ছেলেমেয়েদের খাওয়ালেই হত। তার জন্য আনার আর এমন কিছু দরকার ছিল না। বাবা কোনও জবাব দিল না তখন। বরং বসল খবরের কাগজ নিয়ে।
এমনই ঘটে, ঘটে তাকে প্রত্যেকবার। এমনই বলে মা, আর বাবা এমনই কাগজ পড়ে বছরের পর বছর। আর মায়ের পায়ের মানচিত্র নিয়ে গিয়ে পছন্দমতো জুতা কেনে। একটা সাদা কাগজ বাবা পেতে দেয় আর মা লজ্জা-লজ্জা মুখ করে তার ওপর বাঁ পা রাখে। আর বাবা বাঁ পা তুলে কাগজে ডান পা রাখতে বলে মাকে। মা পা বদলায়। বাবা তখন যত্ন করে এঁকে নেয় মায়ের পায়ের মানচিত্র। তারা তিনজন, তিন ভাইবোন, মাবাবাকে ঘিরে ধরে দৃশ্যটা দেখে। গম্ভীর থাকে তখন তারা। কিছুটা উদ্বিগ্নও। যেন কী এক মহাকাণ্ড হয়ে চলেছে।
বাবার আঁকা হয়ে যাবার পর মা বাবার পায়ের ধুলো নেয়। আর এই পর্যন্তই তারা শান্ত দাঁড়িয়ে থেকে পুরো কাণ্ডটি ঘটাতে সাহায্য করেছে বরাবর। এমনকী মায়ের জুতো কেনার সময়ও বাবাকে তারা দেখেছে গভীর মনোযোগী। প্রকৃতপক্ষে জুতো নয়। চটি। মায়েরা জুতো পরে না কখনও-ই। পরে চটি। বাবা সেই চটি কিনে দেয়। তাদের জুতো কিনে দেয়। উপহার দেয় না। আর কবে যেন, এরকমই চলতে চলতে সব থেমে, গেল একদিন। কবে থেমে গেল! কোন বছর! ক্যালেন্ডারে কেউ লিখে রাখেনি দিনক্ষণ।
চন্দ্রাবলীও কিনে দিয়েছিল। জুতো কিনে দিয়েছিল। তার দেবার কোনও শেষ ছিল না। বস্তুগত আর বস্তুর অতীত সবই সে পরম উপাদেয় করে তুলে ধরতে চাইত তার জন্য। সে চন্দ্রাবলীকে মুখে পুরত আর কুলকুচি করার মতো ছুড়ে দিত পরক্ষণে। এ রকমই চলতে চলতে সব থেমে গেল একদিন। কবে থেমে গেল! কোন বছর! এই তো, এক বছরও পেরোয়নি। কোন দিন! কোন মাস! সে ক্যালেন্ডারে লিখে রাখেনি দিনক্ষণ।
কী দিত তাকে চন্দ্রাবলী? কী কী দিতংজার গা গুলিয়ে ওঠে। কেন, সে জানে না। তবে চন্দ্রাবলী সম্পর্কে তার এই অনুভূতি নতুন নয়। এই বিবমিষা নতুন নয়। ঘৃণায় পেট মোচড় দেয় তার। সে দাঁড়ায়। দু’ হাতে পেট চেপে ধরে এবং ওয়াক তোলে। নিজের সম্পর্কে কিছুটা সম্বিৎ ফেরাবার চেষ্টা করে সে। কখন খেয়েছিল শেষ? পেট খালি? অম্বল হয়ে গেল? চৈনিক খাবারের স্বাদ-গন্ধ তার মনে পড়ে। আর মনে পড়ে চন্দ্রাবলীর কোমর। চওড়া ভারী কোমর। এক অসংবৃত পশ্চাৎ। বহু অপ্রয়োজনীয় মাংসে বিসদৃশ। কালো রং। কোমরের ওপর থাক থাক মাংসল ভাঁজ। সালোয়ার কামিজের ওপর দিয়ে সেইসব চূড়ান্তভাবে পরিস্ফুট থাকে। আর শাড়ি পরলে কিংবা পোশাক উন্মোচিত যখন—ওই পরতের পর পরত মাংসল খাঁজে জমে থাকে গাঢ়তর অন্ধকার। কিংবা প্রকৃতপক্ষে কালো তার ত্বকের বাহার আসলে জমে থাকে রজনী সদৃশ। আর সেই তমস পেরিয়ে চওড়া পুরু পিঠ। প্রস্থই অধিক হয়েছে ক্রমশ। দৈর্ঘ্য ছাপিয়ে। কায়িক স্ফীতিকেই যেন সে বরেণ্য ধরেছে। এই প্রস্থেরই, স্ফীত প্রস্থেরই উল্টো পিঠে কণ্ঠ হতে নেমে আসা উত্তাল স্তনদ্বয়। ভারী ও তুমুল। বুকে কোনও উপত্যকা রাখেনি তার পেশির অপরিমিত, অযোগ্য বিস্তার। ভারী-ভারী-ভারী স্তন। শাসরুদ্ধকারী স্তন—যা সে প্রথমবার স্পর্শ করেছিল, তার সরু, কোমল, সাদাটে আঙুল দ্বারা স্পর্শ করেছিল না-দেখেই। কাম ছাড়া, তীব্র খিদে ছাড়া, এতটুকু মায়া ছিল না তার আঙুলের শীর্ষদেশে।