সে দেখে, নির্মোহে দেখে এবং নড়বড় করতে করতে, ভারসাম্য রাখতে রাখতে ব্যাগের ভেতরটা ঠিক করে নেয় একবার। চেন বন্ধ করে এবং লক্ষ করে তার জুতোর ডগায় হাঁ-মুখ। সে, নাক গড়িয়ে নেমে আসা চশমাটা ঠেলে দেয় একবার ওপরের দিকে আর ভাবে। ভাববার সময় তার ঠোঁটজোড়া অল্প ফাঁক হয়ে থাকে। সেই সময় তার মুখে কোনও খুশিভাব থাকে না। মাথাজোড়া মণ্ডলে লেগে যায় বিষণ্ণতার দাগ। আর সেই দাগ রুমালে মুছলেও যায় না। কেন-না সমস্ত বিষণ্ণতা অপসৃত হওয়ার জন্য হাস্য অপেক্ষা করে। এখন হাসি তাকে ছেড়ে চলে গেছে। ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে দেখা যাচ্ছে অসমান দাঁতের সারি। সে হাসলে এই এবড়োখেবড়ো পঙক্তিতেই আলোক প্রতিফলিত হয় এবং তাকে করে ঝলমলে, আকর্ষণীয়, প্রাণবন্ত।
এখন সে চলতে চলতে এমনই শ্লথ যেন তিমিত দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে হাসিখুশি এক খতনামার জৌলুস। সে নজর করছে না। ভাবছে। এই যে বড় শহর, যার পথ-ঘাট দিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে এখন, তার কতইনা বাজার, আর সেইসব বাজারে কতইনা জুতোর দোকান। সার-সার জুতো। বিচিত্র রং ও আকৃতি। সে এই জুতোজোড়া কিনেছিল এই শহরেরই একটি সুসজ্জিত দোকান থেকে। তার সঙ্গে তখন চন্দ্রাবলী ছিল। জুতোর দামও সে-ই দিয়েছিল। বারবার উপরোধ করেছিল একজোড়া ভাল জুতো কেনার জন্য। সে ব্যয়ের কথা ভেবে সবচেয়ে সস্তা জুতোজাড়াই খুঁজছিল। চন্দ্রাবলী মনে করিয়ে দিয়েছিল চলাফেরাই তার কাজ। সুতরাং জুতোজোড়া মজবুত হওয়া দরকার। মজবুত এবং আরামদায়ক। কেন-না পা দুটিকে যত্ন ও সম্মান করা উচিত–শরীরের একজোড়া অপরিহার্য ও কর্মঠ অঙ্গ হিসেবে। কিন্তু ভাল জুতোর চূড়ান্ত পর্যায় চন্দ্রাবলীরও ব্যয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল না। সে তখন একটু মাঝামাঝি জায়গায় রফা করে। দাম দেয়।
আজ ছিঁড়ে যাচ্ছে। ফেটে যাচ্ছে। চন্দ্রাবলীর কেলা জুতো। চন্দ্রাবলীর উপহার দেওয়া জুতো। শুভদীপ নিজের শার্টের দিকে তাকায়। চন্দ্রাবলীর উপহার। প্যান্টের প্রতি দৃকপাত করে। বিখ্যাত তকমা, রেমন্ডস। গত পুজোয় চন্দ্রাবলীর দেওয়া। নিজের অজান্তে তার হাত চলে যায় চশমায়। এই দৃষ্টিযন্ত্র চন্দ্রাবলীর দেওয়া প্রথম বস্তু। একটি ডাঁটিভাঙা চশমা সে পরে চালিয়ে দিচ্ছিল দিনের পর দিন। চন্দ্রাবলী, দেখে ফেলার পরই তাকে জোর করে দোকানে নিয়ে যায়। এবং সে বছরই তার জন্মদিনে তাকে উপহার দেয় এই ব্যাগ। ডাকব্যাক। কলহংসের পিঠের মতো মসৃণ ও জলরোধক।
উপহার। উপহার দিয়ে তাকে ভরে দিতে চাইত চন্দ্রাবলী। গান শেখানোর আয় থেকে নিজের খরচ সামলে এইসব উপহার সহজ নয় সে জানে। কিন্তু চন্দ্রাবলী আশ্চর্য ইচ্ছার কথা বলত। ইচ্ছার অপরিমেয়শক্তির কথা বলত। বলত, শুভদীপ তার জীবনে আসার পর সে পেয়ে গিয়েছে এক অতি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন। রুপোর ছাতের তলায় সোনার থালায়, হিরেকুচির ভাত খাবার কোনও লেশই ছিল না সেই স্বপ্নে। দু’কামরার ছোট বাড়ি, শুভদীপের বাজারের থলে থেকে একটা একটা মাছ, সবজি নামিয়ে দোপাট্টায় ঘাম মুছে রান্না চাপানো আটপৌরে জীবনের হুবহু প্রতিচ্ছবি। সে বলত আর শুভদীপ অসহিষ্ণু ক্রোধে তলায় তলায় ছটফট করত। এইসব আটপৌরে জীবনকে সে ঘৃণা করত, যেমন করত চন্দ্রাবলীকে…।
ইচ্ছা। ইচ্ছা। চন্দ্রাবলী ইচ্ছার কথা বলত। ইচ্ছার শক্তির কথা। সে মনে করত, স্বপ্ন আসলে ইচ্ছা। ইচ্ছাই নিজেকে লক্ষ্য বা স্বপ্ন হিসেবে স্থাপন করে, ইচ্ছাই নিজের মাধ্যমে জীবনকে লক্ষ্য বা স্বপ্নের নিকটতমে পৌঁছে দেয়।
সে, শুভদীপ, এইসব কথাকে গুরুত্ব দেয়নি কখনও। বরং শুনতে শুনতে সে অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে কালাতিপাত করত। কিংবা, ঘন গাছের তলায়, জলাশয়ের ধারে, জোড়া জোড়া মানব-মানবীর মাঝে তারাও। সন্ধে নেমে এলে হাত ধরাধরি করত। তখন, জলের তলা থেকে উঠে আসত চাঁদ। বড়সড় চাঁদ। গোল চাঁদের উত্থান। সেই উত্থানের মুখোমুখি বসে গোল চন্দ্রাবলী বলে যেত তার ইচ্ছের কথা, অথবা রবি তরফদারের গৃহে থাকাকালীন তার প্রাপ্ত অবহেলা ও নির্যাতনের কথা। বলে যেত না থেমে। একটানা। ওই নির্যাতনের কবল থেকে সে যে বেরিয়ে আসার সাহস শেষ পর্যন্ত অর্জন করতে পেরেছে–আর পেরেছে শুভদীপের সান্নিধ্যের প্রভাবেই—এ কথাও বলত বার বার। শুভদীপ তখন তার নরম বঙুলে হাত রাখত। চাপ দিত। নিষ্পেষণ করত। তার সারা শরীরের ক্ষুধা, ওই মুহূর্তে, ওই নিষ্পেষণের মাধ্যমে মিটিয়ে নিতে চাইত সে।
এক বয়স্ক মহিলার বাড়িতে আরও তিনটি মেয়ের সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে আতিথ্য নিয়ে থাকত চন্দ্রাবলী। সেই মহিলা, ক্ষ্যামাঙ্গিনী নাম এবং সহবাসিনী তিনজন সম্পর্কেও তার অভিযোগ কম ছিল না। ইচ্ছাশক্তি দ্বারা এই অপছন্দের অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার স্বপ্ন সে দেখত আর বলত সেসব ‘শুভদীপকে। সে শুধু অপেক্ষা করছিল, কবে রবি তরফদারের কাছ থেকে সে আইনত বিচ্ছেদ লাভ করে।
শুধুমাত্র এইসব উপহার ও স্বপ্নের মধ্যেই চন্দ্রাবলী থেমে থাকেনি। ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে একটি পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যাকউন্ট খোলে এবং তার উত্তরাধিকারী করে দেয় শুভদীপ ভট্টাচার্যকে। জুতো কিনে দেবার দিনই তাকে পাসবই খুলে দেখায় চন্দ্রাবলী এবং দেখানোর সময় তার মুখে তৃপ্তির অভিব্যক্তি টসটস করে। শুভদীপ সেদিকে মন দেয়নি কেন-না, চন্দ্রাবলীর মৃত্যু পর্যন্ত জড়িয়ে থাকবে এমন সম্ভাবনা সে স্বপ্নেও কবুল করেনি কখনও। সে, অতএব, জুতোর দোকান খোঁজার দিকে মন দিয়েছিল তখন। এবং চন্দ্রাবলীর উপহার দেওয়া জুতো নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল।