কিংবা আরও আরও সব, অসংখ্য সব বেহিসাবি অর্থহীন হস্তান্তর।
যেভাবে কতিপয় মানুষ এক ভূখণ্ড অনায়াসে তুলে দেয় অন্য ভূখণ্ডের অধীশ্বরের হাতে, আপন ভূমিকে মাতৃসম জ্ঞান করে না, বরং হয়ে ওঠে নির্মম, অতি নির্মম ও লোভী–ঠিক সেভাবেই জীবনও নির্মম। জীবনও লোভী।
কিন্তু জীবনের লোভ কী ভাবেই বা প্রতিভাত হয়! জানে না সে। হতে পারে, মৃত্যুর ওপর জীবনের দখল প্রমাণ করার লোভ। জীবনানয় অমোঘ, নয় নিরবচ্ছিন্ন। নয় চূড়ান্ত শক্তিমান। জীবন, স্রষ্টার শক্তির সীমায়িত অভিজ্ঞান মাত্র। কিন্তু মৃত্যু অখিলে প্রলম্বিত। নিরবচ্ছিন্ন সে আলোয় অথবা অন্ধকারে। মৃত্যু সর্বশক্তিমান। সর্বব্যাপক। তারই কাছে জীবন অবহেলায় ছুড়ে দেয় স্তব্ধ প্রাণ। যখন যাকে ইচ্ছে ছুড়ে দেয়। যেমন অনায়াসে অবাধ্য স্ত্রীকে স্বামী প্রবেশ করিয়ে দেয় প্রজ্বলিত তন্দুরে।
জীবনের লোভ এখানেই। শক্তি প্রদর্শনের লোভ। অবলীলায়, অনায়াসে যা কিছু করতে পারে, এমন প্রমাণ দাখিলের লোভ। যেন জীবন, মানুষেরই মধ্যে এক পেশিসম্পন্ন প্রাণী। সে, অতএব, জীবনকে ভাবতে থাকে লুব্ধ, নির্দয়, নির্মম-যে-কোনও নারীর মতোই। প্রতারক। মিথ্যাচারী। তার প্রতি কেশের আদ্যোপান্ত জড়িয়ে আছে অসত্য।
হ্যাঁ, জীবন। তার কাছে জীবন অসত্যে পরিপূর্ণ। দয়াহীন। করাল। এবং জীবন অবশ্যই নারীদেহধারী। নারীরূপী। যদিও এই রূপ সে কল্পনা করতে পারে না। সে জানে মৃত্যুকে। কল্পনা করে মৃত্যুকে। মৃত্যু-এক স্নিগ্ধ স্বাস্থ্যবতী নারী, যার পানপাতা ডৌলে তিরতিরে আলোর মতো ফর্সা মুখ। হরিণের চোখের গড়নেই চোখ, তবে সেই জোড়া ব্ৰস্ততা হারায়। প্রকৃতপক্ষে সে পিঙ্গলনয়না। তিলফুল নাক। ঘন কালো চুল সুদীর্ঘ দীর্ঘতর, মিশে গেছে অন্ধকারে। সে পরিধান করে আছে সাদা সুক্ষ্ম বস্ত্র। তাঁত নয়। রেশম নয়। বরং আধুনিক পদ্ধতিতে, রাসায়নিক সংশ্লেষে তৈরি স্বচ্ছ শাড়ি। আবরণের অন্তরালে স্পষ্ট থাকে গাঢ় শরীরী খাঁজ। আর ওই সমূহ খাঁজ তাকে আহ্বান করে। সে জাগ্রত অবস্থায়, ঘুমন্ত মানুষের অভিব্যক্তিতে খাঁজগুলি লক্ষ করে হাঁটে। হেঁটে যায়। পৌঁছতে পারে না। পৌঁছনো সহজ নয়।
তবে, সেই শরীর অভিমুখে সে হেঁটে যাচ্ছে স্বেচ্ছায়। কিন্তু, যারা স্বেচ্ছায় আসেনি, জীবন যাদের হঠাৎ ছুড়ে দিয়েছে, তারাও বুকের গাঢ় খাঁজে ডুবে যায় রীতিমতো। সেখানে স্থান অকুলান হয় না কখনও। জীবন থেকে মৃত্যর কাছে পৌঁছুনোর কঠিনতর পথ জীবন অতিক্রম করিয়ে দেয় এক লহমায়। মৃত্যুর অনুমোদন ছাড়াই। একনায়কতন্ত্রী মনোভাবে মৃত্যুকে সে করে তোলে দুর্বিনীত জীবনের আদেশ পালনকারী।
০২. জীবনের আদেশ সে পালন করবে না আর
সে স্থির করে, জীবনের আদেশ সে পালন করবে না আর। প্রতারক জীবনের আদেশ, লোভী জীবনের আদেশ আর মান্য করবে না সে। বরং এই ধরিত্রীর অববাহিকায়, যেখান দিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে আর সঙ্গে কোনও জলের বোতল নেই, খাদ্যসম্ভার নেই, সে হেঁটে যাচ্ছে নিজের আত্মাকে বহন করে, তরুণ ও নির্মেদ দেহবন্ধে, সেই অববাহিকায় সে হেঁটে যাচ্ছে আর রেখে চলেছে পদচ্ছাপ, আর সেই পদচ্ছাপে মৃত্যুর আলো ফুটে উঠছে, তার অন্তরে লালন করা আলো। মৃত্যুর আলো। অন্ধকার নয়, আলো। কোনও গ্লানি নেই, আশা নেই, উদ্বেগ নেই, যন্ত্রণা নেই, ক্ষয় নেই, ক্ষতি নেই শুধু আলো। শুধু এক অনির্বাণ অস্তিত্বের বিস্তার। আদি-অন্তহীন বিস্তার। জীবন অন্ধকার আর মৃত্যু আলো। এতকাল মৃত্যুই ছিল অন্ধকার। মৃত্যুই ছিল রজনী। অন্ধের দৃষ্টিহীনতা। কিন্তু আজ, সে, শুভদীপ, জেনেছে–পৃথিবীর অন্তত একজন মানুষ জেনেছে, মৃত্যু আলো। এবং মৃত্যু স্থির। মৃত্যু নিশ্চিত। মৃত্যু বিশ্বস্ত। মৃত্যুর থেকে মুখ ফিরিয়ে জীবনের দিকে দৃষ্টি মেলে দিলে উপলব্ধি করা যায়–জীবন আসলে কী অস্থির, কী অনিশ্চিত, কত গভীর ষড়যন্ত্রময়, প্রতারণাময়। জীবন কী গভীর অন্ধকার!
অতএব সে চলে যাচ্ছে প্রতি পদচ্ছাপে আলোর ফুল ফুটিয়ে ফুটিয়ে। আকাশ উপুড় হয়ে আপন সাজিতে ভরে নিচ্ছে সেই সব ফুল আর তারা মিটমিট করছে। যেন সব সুনয়নী, সব সুনেত্রা ঘুম থেকে জেগে উঠল এইমাত্র আর অপেক্ষা করছে, ব্রাশ-পেস্ট-বিস্কিট-বর্ণপরিচয় মেশানো এক সকালের জন্য।
কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে এই আলোর ফুল, ফুটে থাকা এইসব মৃত্যুর কোনও প্রত্যাশা নেই। এক বিশাল, অসীম, সর্বব্যাপ্ত, সর্বত্রগামী মৃত্যুর থেকে খান-খান হয়ে বেরিয়ে আসা অসংখ্য-অসংখ্য মৃত্যুর কোনও প্রত্যাশা নেই। অপেক্ষা নেই। টান নেই। বড় নির্মোহ, নির্বাক তারা।
সে জানে না। সে বোঝে না। সে এক নির্মোহের প্রতি মোহগ্রস্ত ইদানীং। অকারণ সে হেঁটে চলে। তার যেখানে যাবার কথা, যেদিকে যাবার কথা, না গিয়ে সে হেঁটে চলে অন্য রাস্তায়। আর এভাবে, জীবনকেও কিছুটা মান্য করা হয়ে যাচ্ছে তার, সে জানে না। যে-পথে যাবার কথা, না গিয়ে, অন্য পথে চলে যাবার এই চিরকালীন বাঁধাকে সে প্রতিপন্ন করছে মৃত্যুর উদ্দেশে, কিন্তু জীবনের পরিণামেই। সে জানে না, সে হেঁটে যায়। এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মসৃণ রাস্তায় হোঁচট খায় একবার। হোঁচট খায় বলে থামে। কাঁধের ব্যাগ অকারণে ঠিকঠাক করে নিতে চায়। একটি পা তুলে, যেনবা পদক্ষেপ নিতে চলেছে এমন, কিন্তু নিচ্ছে না, সে একখানি কাল্পনিক টেবিল গড়ে নেয়। নড়বড়ে টেবিল। তার ওপর রাখে ব্যাগ। চেন খোলে। ব্যাগে প্রচুর কাগজ। দুটি ফাইল। কলম। প্যাড। আর কিছু চিঠির বান্ডিল।