সাবান হাতে করে উঠোনে আসে মা। এই রাতে, শীতের আভাসে, জামাকাপড় কাচার সারবত্তা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে। সে তখন এক বসন্তরোগীর কথা বলে। তার পাশে বসেছিল বাসে। এমন বলে। সবকিছুই বড় আগে আগে এসে যাচ্ছে এখন। গ্রীষ্মের মধ্যেই এসে যাচ্ছে বর্ষা। আর শীত না পড়তেই এসে যাচ্ছে বসন্ত। এইসব বলতে বলতে মা ঘরে ফিরে যায়। খাবার গরম করার আয়োজন করে।
বাইরে পরে যাবার মতো একটি প্যান্ট, দু’খানা শার্ট। শার্টদুটো সে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পরে। চন্দ্রাবলী একটি জিনস দিয়েছিল তাকে। তোলা আছে। আরও শীত নামলে পরবে। অথবা পরবেই না। আর কোনও দিন চন্দ্রাবলী তাকে শার্ট-প্যান্ট দেবে না। জিনস দেবে না। জুতো, ব্যাগ দেবে না। কিনে দেবে না চশমার ফ্রেম।
চন্দ্রাবলী তাকে একটি শার্টই দেয়নি। একটি প্যান্টই দেয়নি। দিয়েছে আরও। সে নিজের থেকে বিশ্বদীপকে দিয়েছে। একটিমাত্র ছেড়া শার্ট আর ছেড়া প্যান্ট পরে ঘুরত ছেলেটা।
গুনগুন স্বরে সুর গলিয়ে উঠোনে আসে বিশ্বদীপ। শুভদীপ লক্ষ করে—মহীনের ঘোড়াগুলির সুর। শুচুর মাধ্যমে তারা সবাই মহীনের ঘোড়াগুলি দ্বারা সংক্রামিত।
মাত্র দুটি পঙক্তির সুর গড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বদীপা চড়া পর্দার সুর। ভেবে দেখেছ কি তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে তারও দূরে তুমি আর আমি… ভেবে দেখেছ কি…। যাই ক্রমে সরে সরেবলতে পারছে না সে। গাইতে পারছে না। স্বর পৌঁছচ্ছে না তার। শুভদীপ জামা-প্যান্টে সাবান মাখছে। কলপারের কাছাকাছি পরিত্যক্ত তুলসীমঞ্চের আড়ায় বসছে বিশ্বদীপ। জানাচ্ছে, চাকরিটা হয়ে যাবে হয়ত। কিন্তু তার আগে কিছু বেয়াড়া শর্ত আছে। গৃহস্থালির জন্য প্রয়োজনীয় ছোটখাটো যন্ত্র বিপণনের কাজ। প্রথম ছ’মাস শুধু গাড়িভাড়ার বিনিময়ে বিপণন। তিনদিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে নেবে সংস্থাটি। এবং কাজ শুরু করার পর প্রতি মাসে একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ণয় করে দেবে। লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করতে পারলে চাকরি নিশ্চিত। তখন চমকদার বেতন পাবে তারা। যদি চাকরি না পায় শেষ পর্যন্ত, তা হলেও লাভ কিছু আছে। লাভ অভিজ্ঞতা। বিপণনের জগতে অভিজ্ঞতা একটা বড় ব্যাপার। এই সংস্থার অভিজ্ঞতা তাকে একটি সুগম ভবিষ্যতের সন্ধান দিতে পারে।
শুভদীপ জানে। এরকমই হয়। সে যে একটি ছোট সংস্থায় কাজ করে, সেখানেও তিন মাস বিনা বেতনে কাজ করতে হয়েছিল তাকে। শতকরা এক ভাগ সে পেত সমস্ত সংগৃহীত বিজ্ঞাপনের মোট মূল্যের ওপর। আলাদা করে গাড়িভাড়াও পায়নি। তবে তার কোনও লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট ছিল না। সে নিজেই নিজের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল। প্রথম মাসে তার আয় হয় তিনশো টাকা।
বিশ্বদীপ জানায়, সে যোগ দেবে বলেই ভাবছে। শুভদীপের মত সে জানতে চায়। শুভদীপ তাকে যোগ দিতে বলে। তিন দিন পর তাকে যেতে হবে আবার সে জানায়। শুভদীপ চুপ করে থাকে। হিম জলে আঙুল টন টন করে। সাবানের ফেনা ছিটকে চোখে-মুখে লাগে তার। তিনটে একশো টাকার নোটের কথা তার মনে পড়ে আবার। কত কিছু হতে পারত এ টাকায়। মার একটা শাড়ি হতে পারত। কিংবা, বিশ্বদীপ কাজে যোগ দিলে হাতখরচ হিসেবে দেওয়া যেত তাকে কিছু।
তার গা ঘিনঘিনে ভাব হয়। আর একবার স্নান করার কথা সে ভাবে। বিশ্বদীপ শুভদীপের কেচে দেওয়া জামাকাপড় নিয়ে মেলে দিতে থাকে এবং কথা বলে যায়। নিচু গলায়, মা শুনতে পাবে না এমনভাবে বলে–চাকরি পেলেই সে মিঠুর সঙ্গে বিবাহ নিবন্ধীকৃত করঝেকারণ মিঠুর সম্বন্ধ দেখা হচ্ছে। শুভদীপের মায়ের কথা মনে পড়ে। যেচে আসা সম্বন্ধ—মা বলছিল। মিঠুর জন্যও কি যেচে সম্বন্ধ আসছে?
শুভদীপ নিবন্ধীকরণের ঔচিত্য সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করে না। বালতি থেকে গায়ে জল ঢালতে ঢালতে সে বিশ্বদীপকে দেবনন্দনের ইচ্ছার কথা জানায়। বিশ্বদীপ হাসে। বলতে থাকে, দেবনন্দন আর শুচু প্রেমে আবদ্ধ। শুভদীপ আরও একবার বিস্মিত হয়। শুচু এবং প্রেম—এই দুই প্রান্তকে সে কিছুতে মেলাতে পারে না। তা ছাড়া, দেকনন্দন তার ছোটবেলার বন্ধু, তার অন্তরঙ্গ বন্ধু, তাকে বলেনি কিছুই। কেন? ক্রোধ জাগে না তার, অভিমান জাগে না। শুধু এক অধস্থবির মানসিকতায় ধীরে ধীরে বিস্ময়ঘোরে তলিয়ে যায়। বিশ্বদীপ কথা বলে ওঠে আবার। বলতে থাকে, সত্যিকারের প্রেমিকের মতোই দেবনন্দন শুচুকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চায়। দেবনন্দনের প্রশংসায় উচ্চকণ্ঠ হয় সে। কিন্তু সেই উচ্চকণ্ঠ শব্দগুলি শুভদীপের শ্রুতি বিদ্ধ করে না। শুধু সত্যিকারের প্রেমিক’ শব্দটি তাকে ঘিরে ঘুরপাক খায়। সে গামছায় চুল মোছে আর কথাগুলি তার মাথায় ঢুকবে বলে ঘুরপাক খেতে খেতে জায়গা খোঁজে। খোঁজে আর ঠোক্কর খায় হাতে বা গামছায়। বিশ্বদীপ আবার নিচুকষ্ঠে ফিরে যায় এবং মিঠুর প্রসঙ্গে অবতরণ করে। মিঠু এখন কারওকে কিছু জানাবে না, যত দিন পর্যং ম বিশ্বদীপ উপযুক্ত হয়।
উপযুক্ত। কীসের উপযুক্ত? বিয়ের। কীসের উপযুক্ত? মি স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারার। কীসের উপযুক্ত? সত্যিকারের প্রেমিক হতে পারার।
তা হলে, সত্যিকারের প্রেমিক হতে গেলে কোনও চাহিদা নেই ভালবাসায় টইটম্বুর হৃদয়খানির। বরং অনেক বেশি প্রয়োজন টইটম্বুর পকেট।
একটি মেয়েকে স্ত্রীর মর্যাদা দেবার জন্য শুধু ভালমানুষ হলেই চলবে না। থাকতে হবে উপার্জনের নিশ্চয়তা। থাকতে হবে কর্মক্ষেত্রের কৌলিন্য।