শার্ট খোলার সঙ্গে সঙ্গে যে শীতের ভাব লাগছিল তার গায়ে, নিমেষে সেটি উধাও হয়ে যায়। বরং গরম স্রোত নামতে থাকে কান মুখ বুক পিঠ বেয়ে। তিনশো টাকা! তিনশো টাকায় মশারি। অনায়াসেই হত। হতে পারত। সংসারে টানাটানিটা থাকত। কিন্তু একটা জিনিসও বাড়ত।
মা দরজা বন্ধ করে ফিরে এসেছে ঘরে। সরাসরি ওষুধের কথা বলছে। শুচুর কথা বলছে। আজ দুপুর থেকে শুচুর গায়ে জ্বর। তারপর, গৃহ্য কথা জানাবার মতো গলা নামিয়ে, শুভদীপের বুকের কাছাকাছি এসে মা জানাচ্ছে, দেবনন্দন এসেছিল। দেবনন্দন তার বন্ধু। খুব ছোটবেলা থেকে অন্তরঙ্গ বন্ধু। সে প্রায় রোজই আসে। সুতরাং তার আসার মধ্যে বিশেষত্ব কী; শুভদীপ বুঝতে পারছে না।
মার ভাঙাচোরা মুখে উজ্জ্বলতা। বিরক্তি উধাও ঠোঁটে চাপা হাসি। মিটমিটে আলোয় সে ঔজ্জ্বল্য রাঙা দেখাচ্ছে। তবে চাপা হাসিটা বোঝা যাচ্ছে ঠিকঠাক। মা জানাচ্ছে তখন, দেবনন্দন শুচুকে বিয়ে করতে চায়। সব কিছু জেনেশুনে বিয়ে করতে চায়।
শুভদীপ হাঁ করে থাকে কিছুক্ষণ। কথা বলতে পারে না। প্রথমেই তার মনে হয়, দেবনন্দন তাকে তো কখনও বলেনি। কেন? তারপরই দ্রুত কিছু ভাবনা তার মাথায় আসে। শীর্ণ, নীলচে, জৌলুসহীন, প্রাণ-শক্তিহীন, ক্ষণভঙ্গুর মেয়েটাকে বিয়ে করে কী করবে দেবনন্দন। কী পাবে! শুচু তার প্রিয়। অতি প্রিয়। তবু এই সব ভাবনা সে ভেবে বসে। এবং এ খবর দেবার সময় মায়ের মুখে যে প্রদীপ্ত আশা, তাকে ঘৃণা করে সে। মাকে স্বার্থপর মনে হয়। রোগা-ভোগা শুচুকে কেন তারা অন্যের হাতে তুলে দেবে। শুধু তো বিয়ের পিড়িতেও মারা যেতে পারে। কিংবা বিয়ের কাগজে সই করতে করতে। ও যে বেঁচে আছে এত দিন, সে-ই তো আশ্চর্য।
হঠাৎ সে উপলব্ধি করে, কত দীর্ঘদিন পর শুচুর মৃত্যুর কথা মনে পড়ল। তার। সে ভুলে গিয়েছিল। তার মনে হয়, মাও ভুলে গিয়েছে। অন্যরাও। এমনকী দেবনন্দনও। কে জানে শুচু নিজেও ভুলে গিয়েছে কি না। সে গায়ে গামছা জড়িয়েও কলপারে যেতে ভুলে যায়। মা বিবৃতি দিতে থাকে। মেয়েলি ঢঙে, মেয়েলি দৃষ্টিভঙ্গিতে, ইনিয়ে-বিনিয়ে কথাবোৱায়। বিয়েই মেয়েদের চূড়ান্ত প্রত্যাশা। একটা ভাল ঘর। বর। মেয়েটা তবু একটু সুখ পেত বিয়ে হলে। যেচে আসা. সম্বন্ধ। পায়ে ঠেলা কি ঠিক? সুখের মুখ দেখা থেকে মেয়েটাকে কি তা হলে বঞ্চিত করা হবে না?
সুখ!সুখ! কীসের সুখ! কেমন সুখ! বিয়ে হলে কি সুখ হয়? যৌনতা? বিয়ে হল যৌনতার আইনসঙ্গত স্বীকৃতি। দেবনন্দন কি শুচুকে… সে দরজার দিকে পা বাড়ায়। অসুস্থনীল বোনের জৈবিক ভাবনাজড়িত চিন্তনকে জোর করে দুরে ঠেলে রাখে। শুধু চৌকাঠ পেরিয়ে যেতে যেতে মাকে জানিয়ে দেয়, শুচুকে পাত্রস্থ করার বিষয়ে তার মত নেই। মা আর কথা বাড়ায় না। সে অন্ধকার উঠোনে পা রাখে।
অন্ধকার গাঢ় নয়। কারণ ছোটঘরের আলো এসে উঠোনে পড়ছে। কলপারেও তাদের অন্য শরিকের ঘরের আলো। সে আর আলাদা করে কলপারের আলো জ্বালল না। তাদের বাড়িতে আজও স্নানঘর নেই। উঠোনের এককোণে কলতলা। সেখানেই সবাই স্নান সারে। মেয়েরা পোশাক পরেই গায়ে জল ঢেলে ঘরে চলে যায়। ছেলেরা গামছা পরে খালি গায়ে সাবান-টাবান মাখে। বিশ্বদীপের স্বপ্ন, চাকরি পেলেই সে প্রথমে একটা মানঘর করবে। টিনের চাল দেওয়া একটা সাধারণ মানঘর করতে হাজার দশেক টাকা লাগবে-সে খোঁজ নিয়ে জেনেছে।
চাকরির জন্য খুব চেষ্টা করছে বিশ্বদীপ। সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে, আর বেসরকারি চাকরির জন্য আবেদন করছে। দৈনিক সংবাদপত্রে কর্মখালির বিজ্ঞাপন দেখে সে প্রতিদিন এবং কর্মসংস্থান সংক্রান্ত কাগজঁগুলো আদ্যোপান্ত পড়ে। কোনও বিশেষ প্রশিক্ষণ নেবার সঙ্গতি নেই। সুতরাং বেসরকারি সংস্থায় সে পেতে পারে একমাত্র বিপণনের কাজ। ইতিমধ্যে কয়েকটি জায়গায় মুখোমুখি পরীক্ষা পর্ব সেরে এসেছে সে। একটি বড় সংস্থা তাকে দ্বিতীয়বার ডেকেছিল। আজই সেই দ্বিতীয়বার যাবার দিন। শুভদীপ এখনও জানে না বিশ্বদীপ গিয়েছিল কি না সেখানে। গিয়ে থাকলেও কী হল জানে না। প্রায় সমস্ত কথাই তারা আলোচনা করে রাত্রে। বিশ্বদীপের বয়স এখন তেইশ। পাঁচ বছরের ছোট সে শুভদীপের চেয়ে। শুচুর চেয়ে দু’ বছরের। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাদের মধ্যে দাদা-দিদি বলার চল নেই। পরস্পরকে নাম ধরেই ডাকে তারা। হতে পারে, শুচু আর সে প্রায় পিঠোপিঠি বলে শুচুকে দাদা বলতে হয়নি। আবার বিশ্বদীপ ও শুচু পিঠোপিঠি বলে এবং দাদা ডাক শোনার প্রচলন ছিল না বলে বিশ্বদীপ ডাকেনি তাদের। মা প্রথম প্রথম বকাবকি করত। বাবার কাছে অনুযোগ করত। কিন্তু বাবা হেসে উড়িয়ে দিত সব। পশ্চিমের দৃষ্টান্ত দিত। শুনতে শুনতে মাও মেনে নিয়েছে। বাবা যতদিন সুস্থ ছিল, মাকে অভিযোগ করতে শোনেনি ভর্দীপ, এই একটি বিষয় ছাড়া।
কলতলায় একটু বেশি শীত টের পায় সে। হঠাৎ আবার মালবিকাকে মনে পড়ে তার। মালবিকার বুক, পেট, নাভি মনে পড়ে। একশো টাকার তিনটি নোটও মনে পড়ে যায় তৎক্ষণাৎ। সে তখন গামছা জড়িয়ে ঘরে ফিরে যায়। শার্ট আনে। গেঞ্জি ও প্যান্ট পরেই আছে তখনও। সে স্থির করে বোয়া কাচা করে ফেলবে সব। শার্ট-প্যান্ট-গেঞ্জি-জাঙিয়া। মায়ের কাছে সাবানের বাক্স চায় সে। ব্যয়সঙ্কোচের জন্য ঘষা সাবান ব্যবহার করে তারা। গুড়ো সাবান নয়, মাঝেমাঝে এক-আধটা পাউচ কিনে আনে তিন টাকা দিয়ে।