এর মধ্যে শুচুকেই বলা যায় বৃহত্তম বিস্ময়। কারণ কলেজে না গিয়ে, কারও সাহায্য না নিয়ে সে একা একা পাশ দিয়েছিল। এমনই, মৃত্যুকে সঙ্গী করে। শীর্ণতার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়েছিল আর গান ভালবেসেছিল। বেশ কিছু ক্যাসেট তাদের সঞ্চয়। বিশ্বদীপ দুটি ছাত্র পড়িয়ে যা পায়, তার থেকে কেনে। হয়তো শুচুর কথা ভেবেই। আর নতুন গান বাজলেই মা টের পায়। কিছুক্ষণ অভিযোগ করে। গান সংসারের তেমন কোনও কাজে লাগে না, যেমন লাগে চাল, ডাল, চালকুমড়ো। শুচু শোনে। বিশ্বদীপও শোনে। কিন্তু চালিয়ে যায় আগের মতো। ক্যাসেটের সংগ্রহ বাড়ে। আর শুচু ঘুরে-ফিরে, সুবলকে খাওয়াতে খাওয়াতে গায় মহীনের ঘোড়াগুলি। শোনে অনেক গান আর খায় শুধু মহীনের ঘোড়াগুলি। হয়তো পঙক্তিগুলি যথাযথ থাকে না। ক্রম বদলে যায়। শব্দও দু-একটা। কিন্তু ও প্রাণ দিয়ে গায়। মোটামুটি স্বরে মোটামুটি করে গায়। আর ওর গান শুনতে শুনতে তাদের সবার মুখস্থ হয়ে যায় গানগুলি। যেমন প্রায়ই সন্ধ্যায় বাবা আর মা টিভি দেখতে থাকলে ও গায় বোেকা বাক্সের গান। মা তখন বিরক্ত হয়। দারিদ্রের দুঃখ অপনোদনের এই এক মাধ্যমের কাছে বসে মা বড় নিবিষ্ট হয়ে যায়। আর শুচু উঠোনে ঘুরে ঘুরে, সুবলের খাঁচার কাছে দাঁড়িয়ে, কলপারের কাছে গজানো সন্ধ্যামণি ফুলের দিকে তাকিয়ে গাইতে থাকে।
পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে
স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে
ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দি
আ-হা-হা-আ–হা
ঘরে বসে সারা দুনিয়ার সাথে
যোগাযোগ আজ হাতের মুঠোতে
ঘুচে গেছে দেশকাল-সীমানার গণ্ডি
আ-হা-হা-আ–হা
ভেবে দেখেছ কি তারারাও যত আলোকবর্ষ দূরে
তারও দুরে তুমি আর আমি যাই ক্রমে সরে সরে
শুচুর অসুখ ধরা পড়ার পর দশ বছর সুস্থ ছিল বাবা। তারপর তার স্নায়ু বৈকল্য হয়। মনস্তাত্ত্বিক জটিলতাও থাকতে পারে। কারণ সংসারের শ্রীমুখে কালির প্রলেপ লাগছিল শুচুর অসুখ ধরা পড়ার পরই। হতে পারে তার জন্য কিংবা কোনও অজ্ঞাত কারণে নিজেকে গুটিয়ে গুটিয়ে এতটুকু করে বাবা পুরোপুরি ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে। তার আগে পর্যন্ত শুচুর সমস্ত তত্ত্বাবধান সেই করত। বাবার হাত থেকে অতঃপর শুচুর দায়িত্ব চলে আসে শুভদীপের হাতে। শুচুর দায়িত্ব এবং শুচুর সঙ্গে সঙ্গে গোটা সংসারেরও ভার। এ যেন সেই জ্বলন্ত মশাল দৌড়। মশাল নিভবে না। দৌড় থামবে না। শুধু বাহকরা বদলে বদলে যাবে। শুভদীপ জানে, সে যদি মরে যায়, এই ভার নেবে বিশ্বদীপ।
ইদানীং শুচুকে আরও শীর্ণ মনে হয়। উচ্চারণেও সামান্য জড়তা এসেছে। জিভ, যেন আড়ষ্ট। নড়তে চায় না। শুভদীপ দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কথা শুনেছে। হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচারের জন্য যারা দুঃস্থদের অর্থ সাহায্য করে। সে যাবে। ভেবেছে। কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তারা দুঃস্থ কি না। দুঃস্থ বলতে যে দৃশ্য আসে, তাদের তেমন নয়। তাদের দরিদ্র জীবনযাপনের গায়ে মধ্যবিত্ততার মায়া বুলানো আছে।
অতএব সে ভাবছে। সাহায্য পেলে শুচুকে নিয়ে সে চলে যেত দক্ষিণে। ভোের শহরে। আর সারিয়ে আনত। ভেলোরে যারা যায়, সবাই সেরে ফিরে আসে। এমনকী এ শহরের প্রধান প্রধান চিকিৎসকরা যাদের জবাব দিয়ে দেন—তারাও। এমনই এক কিংবদন্তি এখন। অতএব সে ভাবছে। ভাবে। যাবে। বলবে তার সাহায্য চাই। ভাবো কিন্তু যেতে পারে না।
বেশ বড়সড় চেহারার বাবা ও সাধারণ মাপের মায়ের সঙ্গে বড় ঘরের বড় বিছানায় বেশ এঁটে যায় শুচু। এই বড় ঘর তার নিজস্ব পরিমাপের চেয়েও, এ সংসারে আরও অনেক বড় হয়ো দেখা দিয়েছে আসলে। এ ঘরেই তাদের সমস্ত। সব বসবাস। টিভি, খাট, আলনা, আলমারি, সাজার টেবিল, জলছাঁকনির বাক্স, টেপরেকর্ডার, ক্যাসেট, কাঁসা-পেতলের বাসন, বসার চেয়ার, বই, ছবি। বস্তুসামগ্রী ঢোকাতে ঢোকাতে এত ঠাসাঠাসি–কোনও কিছুকেই আর নাড়ানো যাবে না। ঘরে ইদুরের ইন্তেকাল হলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
একটি অমোঘ প্রশ্নের জন্য অপেক্ষাকরছিল শুভদীপ। এ প্রশ্ন আর মা মুখে ঝুলিয়ে পথ ছেয়ে দাঁড়াবে না। উচ্চারণ করবে। সে কী জবাব দেবে জানে না। স্পষ্ট কোনও জবাব না দিলেও চলে। সে বলবে, কাজে লেগেছে। কাল ওষুধ এনে দেবে। পর্যটন সংস্থায় যাবে আর টাকা পাবে। সে টাকা থেকে ওষুধ কিনবে। মাসের শেষ হলেই… সেই আবর্তন। সেই দুষ্টচক্র। শেষ পর্যন্ত আবার সংসারের ভাঁড়ারে টানাটানি। আর ঘ্যানঘ্যানানি বাড়বে। বিরক্তি বাড়বে। গোটা জীবনযাপন নির্বোধ চাহনিতে, হাঁ-মুখে তাকিয়ে থাকবে তার দিকে। তাকিয়েই আছে সারাক্ষণ। এই যে মৃত্যুকেই সে ভেবে বসে আছে পরমু মোক্ষ, চিরনারীর কোলে সে আশ্রয় নেবে–এমনই ভেবে চলেছে নিরন্তর, আর তা বাস্তবায়িত করতে পারছে না, তার কারণ হতে পারে এই হাঁ-মুখ সংসার। যেখানে সে প্রায় অপরিহার্য এখন। দশচক্রে ভগবান।
০৫. শার্ট খুলছিল সে
শার্ট খুলছিল সে। বিছানার এক পাশে বাবা। অন্য পাশে শুচু। মা মাঝখানে শোধে। মশারি টাঙানো। বহু পুরনো, বিবর্ণ মশারির সহস্র ছিদ্র কেটে অনেকগুলো বড় বড় ফুটো। তালি মারা হয়েছে কোনও কোনও জায়গায়। কোথাও কাপড় গোঁজা বা সেফটিপিন। কত দিন মশারি কেনা হয়নি? বিছানার চাদর, ঢাকনি—এই সব? শুভদীপ মনে করতে পারে না কিছুতেই। বরং সে একটি মশারির দাম কত হতে পারে ভাবে দুশোতিনশো। তিনশো?