অতএব পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের হাতে-পায়ে অদৃশ্য শেকল। চলনেবলনে অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ। কে কী চায়, কী পথ, কোন জীবন, কী পেশা, কোন সংগীত–সেই সব আর্ত চিৎকার বাতাসে বাতাসে বাজে। তার অদৃশ্য হাত মানুষকে ঠেলে দেয় ছোট্ট বলের মতো। গড়িয়ে দেয় যে-দিকে তার খুশি আর গড়ান নিয়ন্ত্রণ করে না। এমনকী লোফালুফি করে যখন যেমন ইচ্ছে।
এই যে সে, শুভদীপ, সে নিজের ইচ্ছেয় জন্মায়নি, নিজের ইচ্ছেয় শুভদীপ ভট্টাচার্য হয়নি। নিজের ইচ্ছেয় বনে যায়নি নিম্নবিত্ত সংসারের মুকুটহীন অধিপতি। অসংখ্য ভারী, অনপনেয় দায়বদ্ধতা তার ওপর আরোপ করা হয়েছে। কিছু পূর্বনির্ধারিত রীতি অনুসারে, কিছু বর্তমানের তাগিদে। তার জন্য তাকে দেওয়া হয়নি কোনও সতর্কবার্ত। কোনও প্রস্তুতির সময়। যেন এই দায়বদ্ধ করা–এক অধিকার। আর অধিকারের অন্য পিঠে সেই কঠিন বন্ধন। কিন্তু এই অধিকার, এই বন্ধনও নিত্য নয়। চিরস্থায়ী নয়। বাঁধন ওঠে, ছেড়ে, ছিঁড়ে দেয়। অধিকঞ্জবোধ জাগে, পরিণত হয় এবং টুটে যায় একদিন।
সুবল, টিয়ার, জাত, খাঁচায় বসে ঘুমোচ্ছিল। শুভদীপের সাড়া পেয়ে ঘুমন্ত চোখ খুলল। শব্দ করল একবার। আবার ঘুমিয়ে পড়ল। ঘরে এল সে। প্রতিদিনের থেকে এতটুকু আলাদা নয়। যেন একটি দিন আরেক দিনকে নকল করছে মাত্র। যত ক্ষয়, যত বদল, যত গড়ে ওঠা–এতখানি বিন্দু বিন্দু পর্বে-নজরে আসে না। অনেকখানি বড় হয়ে গেলে মনে হয়, প্রস্তুতির সময় কঠিন বন্ধন। কিও দেয়। অধিক এ কী! এ কেমন করে হল! কবে হল!
নিভু নিভু আলো জ্বলছে। বাবার জন্য। খেয়ে-দেয়ে ঠিক দশটায় ঘুমিয়ে পড়ে বাবা। আর মা জেগে থাকে। ঘুমোয় এবং ঘুমের মধ্যেও জেগে থাকে। গত দশ বছর ধরেই এমন। এখন মা আয়ত্ত করেছে নিজস্ব ঘড়ি। কোনও যন্ত্র ছাড়াই ঠিক সময়ে ঘুম ভেঙে যায় মার। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়া মায়ের সঙ্গে স্নাতক ও কারিগরি বিদ্যায় পারদর্শী বাবার বিয়ে হয়েছিল। সমস্ত জ্ঞান এবং পারদর্শিতা নিয়ে বাবা শুয়ে আছে বছরের পর বছর। আর মা বেঁচে থাকার যন্ত্র ও কৌশল আবিষ্কার করছে প্রতিদিন।
বাবার এতটুকু কষ্ট যাতে না হয় তার জন্য আলো নিবিয়ে দেয় মা। দুজনের বয়সের পার্থক্য প্রায় পনেরো বছর। কিন্তু এখন মাকে বাবার সমবয়সী লাগে। বিছানায় শুয়ে পড়ার পর বাবা ধীরে ধীরে মরছে। মা দ্রুত।
কয়েক বছর আগেও তাদের তিন ভাইবোনের কারও না কারও পড়ার প্রয়োজন থাকত। তখন তারা পাশের ঘরে চলে যেত। শরিকি বাড়ি ভাগবাঁটোয়ারার পর এই ঘরখানা তারা পেয়েছে রসুই হিসেবে। ছোট নিচু স্যাঁতসেতে ঘর। একটি মাত্র জানালা। দেওয়ালের একদিকে তাক। তাতে মায়ের রান্নার সরঞ্জাম। জানালা বরাবর গ্যাসের উনুন রাখার টেবিল। বাড়তি একফালি জায়গায় একটা খাট। তারা দু’ভাই তাতে গা ঘেঁষাঘের্ষি শুয়ে থাকে সারা রাত। একজন চিৎ হলে অন্যজনকে পাশ ফিরতে হয়।
খাটের পা-গুলি ইটের ওপর ইট সাজিয়ে উঁচু করা। নীচে জলের পাত্র, চালের ভাঁড়ার, হাঁড়িকড়াই, আনাজ, ছাতা, বঁটি, ময়লা ফেলার পাত্র। বর্ষায় উঠোনের জমা জল হুড়মুড় ঢুকে পড়ে। এই বিছানার ওপর তখন সব তুলে দেওয়া হয়। তারা দু’ভাই পা-ডােবা জলে দাঁড়িয়ে মগ দিয়ে জল ঘেঁচে। আর রাত্রে তখন পাঁচজন এক বিছানায় শোয়। বড় ঘরের বড় বিছানায় পাথালি দিয়ে শোয়। মশারিতে পালৈগে যায় বাবার এবং দু’ভাইয়ের। তারা পা গুটিয়ে শোয়। সারা রাতটান করতে পারে না।
আর এইসব জলহেঁচার কাজে, জিনিসপত্র টানাটানির কাজে দীপান্বিতা ভট্টাচার্যকে তারা নেয় না কখনও। দীপান্বিতা তখন শুচু হয়ে বড় ঘরের খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকে চুপচাপ। কারণ, জল ঘাঁটাঘাটি করলেই ওর জ্বর এসে যায়। সারতে চায় না। তাই শুচুকে ভারী কাজ করতে দেওয়া হয় না। রান্নাও করতে দেওয়া হয় না। মার হাতে হাতে টুকটাক করে। সুবলকে খেতে দেয়। সুবলের খাঁচা পরিষ্কার করে। সুবল একমাত্র ওকেই কামড়ে দেয় না তখন। ওর হাতে মাথা ঘষে অস্ফুট শব্দ করে। শুচু তখন মহীনের ঘোড়াগুলির গান শোনায় সুবলকে …সেই বাড়ির নেই ঠিকানা। শুধু অজানা লাল সুরকির পথ শূন্যে দেয় পাড়ি। আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি… সুবল তার থেকে বেছে নেয় কিছু পছন্দমতো শব্দ। আর আওড়ায় সারাদিন।
কোনও ভারী কাজ করার শক্তিই নেই শুচুর। ওর মধ্যে একটি স্বাভাবিক শীর্ণতা আছে। স্বাভাবিক দৌর্বল্য। Congenital Cynotic Heart Diesease। হৃদযন্ত্রের জন্মকালীন অসুখ।
শীর্ণতার সঙ্গে, নিয়মিত অসুস্থতার সঙ্গে, তারা দেখেছিল, ওর জিভ ক্রমশ নীলচে হয়ে যাচ্ছে। চোখ নীলচে। এমনকী গায়ের রঙেও কালচে নীল ছোপ। যেন বিষ ভরে গেছে শরীরে। চিকিৎসকেরা জানালেন, ওর অলিন্দ ভুলে ভরা, নিলয় ত্রুটিযুক্ত। ওর বিশুদ্ধ রক্তে ঢুকে পড়ছে অশুদ্ধ রক্ত। অস্ত্রোপচার করলে ভাল হতে পারত। কিন্তু তার জন্য চাই এক সমুদ্র টাকা। দুর্ভাগ্য শুচুর। তার বাবার সমুদ্র ছিল না। পুকুরও না। শুধু বালতি একখানা। মাসে মাসে ভরত। আবার খালি হত। এখন ভাইয়ের ঘটিও পূর্ণ হয় না। তার অস্ত্রোপচার কেমন করে হবে! তাই ওষুধ আর ওষুধ আর ওষুধ। মাঝে মাঝে রক্ত দেওয়া। গায়ে চাকা চাকা হয় মাঝে মাঝে। মাথা ঘোরে। জ্ঞান হারায়। মরে যেতে পারে যে কোনও দিন। আধার বেঁচেও থাকতে পারে। বেঁচে আছে যেমন। নীল অপরাজিতার মতো অসম্পূর্ণতায়। কিন্তু ও বেঁচে আছে বলেই, ও যে মূরে যেতে পারে, যেকোনও দিন, সেই সম্ভাবনা মনে রাখে না কেউ। শুচুকে আগলে রাখা অভ্যাস রাখে। যেমন দিনের পর দিন শুধু আলুসেদ্ধ আর ভাত খাওয়া অভ্যাস-খায়। আর সেইসব দিন শুধু বর্ষার জন্য একটু দুধের ব্যবস্থা রাখা। সে-ও অভ্যাসবশে রাখা থাকে অনায়াসে। আর শুচুও এই অসুস্থতা, ওষুধ আর মৃত্যুর সম্ভাবনার ভিতর অভ্যস্ত হয়ে যায় জীবনে। হাঁটা-পথের দূরত্ব ইস্কুলে পড়েছিল সে আর নিকটবর্তী কলেজে নাম লিখিয়েছিল। ডাক্তারের আদেশনামা অনুসারে পরীক্ষা দিয়ে আসত শুধু। আর দেখতে দেখতে তারা স্নাতক হয়ে যায়। তারা তিন ভাই-বোন। বাবার অসুস্থতাজনিত অক্ষমতায় দারিদ্রের দণ্ড তাদের পাঠ ইত্যাদি সম্পর্কে বিরাগ জন্মাতে পারেনি।