তার কাছে একজন মানুষের জন্য একটি নাম। একই মানুষ পর পর চারদিন এলেও তারা সব আলাদা আলাদা লোক। কারণ, সে জানে, আজকের লোকটি আর থাকে না কোথাও। কালকেই অনেকটা বদলে যায়।
ছেলেটি সারা ঘর দেখে। সে হাতে কলম ধরে খাতা ধরে চুপচাপ। ছেলেটি জানতে চায় না কিছু। তার চোখে চোখ সরাসরি। সেই চোখে সুদুরের ভাষা। সে মৃদু হাসে। ঘড়ির দিকে হাত বাড়ায়। তিনশো টাকায় যতটুকু সময় দেওয়া যায়, পেরিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটি ইশারা বুঝে ফেলে দ্রুত। নাম বলে। রুমালে মুখ মুছে নেয়। আর সে নাম লেখে।
দরজা খুলে বেরিয়ে আসে তারা। অজানিত কেউ প্রলম্বিত ছায়া ফেলে তাদের পেছনে এসে দরজা বন্ধ করে যায়।
দু’জন দুদিকে চলে যাবে। কোনও টান নেই। বন্ধন নেই। কোনও দাবি-দাওয়া-অধিকার নেই। শরীর। তুচ্ছ শরীর। মল, মূত্র, কৃমি, কফ, পুঁজ ও রোগজীবাণুমণ্ডিত আকাট শরীর। তাই দিয়ে বন্ধন হয় না কখনও।
গলি থেকে বেরিয়ে মূল রাস্তায় পৌঁছে যায় তারা। হঠাৎ ছেলেটি তার হাত ধরে। প্রশ্ন করে, এই পেশা অবলম্বন করে বেঁচে থাকার চেয়ে আত্মহত্যাকেই তার শ্রেয় মনে হয় কিনা।
আত্মহত্যা। মানে হত্যা। মানে মৃত্যু।
মালবিকা হাত ছাড়িয়ে নেয় এবং দৃঢ় জানায়, এই জীবনে থাকবে বলেই, জীবনের থেকে পালিয়ে যাবে না বলেই, মৃত্যুর অভিমুখে নিজেকে এবং পরিবারের কারওকে যেতে দেবে না বলেই সে অপারগ গ্রহণ করেছে এ বৃত্তি।
ছেলেটি কথা বলে না কোনও ব্যাগ কাঁধে ফেলে ধীর পায়ে হেঁটে যায়। সে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এ বৃত্তি গ্রহণ করা কি সহজ ছিল? ছিল না, ছিল না। অসম্ভব দাহ থেকে যায় সারা জীবন। অসম্ভব কষ্ট। অভ্যাসের আড়ালে সে কষ্ট চাপা থাকে মাত্র।
সে জানে না, এই ছেলেটি, শুভদীপ নাম, অনুভব করে কিনা, জানে কিনা যে কোনও-কোনও পরিবার এক একটি সময় বজ্র-বিদ্যুতে ভরে যায়। তখন জ্বলে জ্বলে ছাই হয় মানুষগুলি।
এই যে তারা, নিরুপায় বৃত্তিকে নির্ভর করে জীবনকৈ ধারণ করেছে, প্রাণকে ধারণ করছে, তার সঙ্গে-সঙ্গে ক্ষয়ও কি ধারণ করছে না?শুকনো বালুরাশির ওপর দিয়ে ছুটতে চাইছে তারা। হাত নড়ছে, পা চলছে, পেশির আন্দোলন ঘটে যাচ্ছে কিন্তু গতি আসছে না। জীবন-জীবন করে মাবাবা-ভাই কেউ আর ঠিকঠিক মা-বাবা-ভাই নেই, যে রকম থাকার কথা ছিল। সেও নেই যথাযথ মালবিকা। সে হারাল কাহীরাল পরের বর্ণ, আর সকলকেই নিয়ে পরিচয় ভাসিয়ে শুধু বেঁচে থাকল। বেঁচে থাকতে হয় বলে বেঁচে থাকল। বজ্রবিদ্যুৎ প্রত্যাহৃত হলেও তারা আর স্বাভাবিক হবে কখনও। বেশ্যাবৃত্তির গাঢ় দাগ তাদের গায়ে দগদগে লেগে থাকবে।
একটি গাড়ি আলোর ঝলকে চোখ ধাঁধিয়ে দেয় তার। গম্ভীর ভাবনা, থেকে বেরিয়ে আসে সে। ছেলেটি চলে গিয়েছে কোথায়। সে সামনের দিকে তাকায়। লোকের ভিড় এখানে। বাস ধরার জন্য জমায়েত সব। এক মধ্যবয়সী পুরুষ, গোঁফদাড়ি নিখুঁত কামানো, হাতে বান্স, গাঢ় নীল কোটের মাঝখানে টকটকে লাল গলাবন্ধ, আকুল অসভ্য ভুড়ি দৃশ্যমান অভিজাত পোশাকের ফাঁকে। সে এই লোকটির লোভী চোখ দেখে। চকচকে ইচ্ছাময় দৃষ্টি দেখে। আর মনে মনে বড়সড় দাও মারার অভিপ্রায়ে মৃদু হাসি তুলে অগ্রসর হয়।
০৪. বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে এগারোটা
বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে এগারোটা গড়িয়ে গেল। তাদের পুরনো ইট-বেরকরা দেওয়ালের দিকে তাকাল সে কিছুক্ষণ। মালবিকা নামে মেয়েটির বাড়ি থেকে খুব বেশি কিছু আলাদা? না। ক্ষয়িষ্ণুতার দৌড়ে পিছিয়ে নেই দেওয়াল। তবে কজাগুলো আজও শক্তিমান। এখনও আলগা করেনি বাঁধন। জানালাদের ঝুলে পড়তে দেয়নি।
কত দিন রং হয় না বাড়িটায়। ছাদ থেকে, দেওয়াল থেকে মেঝে অবধি মেরামতির প্রয়োজনীয়তা প্রকাশিত। বর্ষাকালে ঝর্নার মতো জল গড়ায় ছাদ থেকে। নোনা ধরে গেছে দেওয়ালে। দরজা-জানালা বিবর্ণ। মেঝের মসৃণতা হারিয়ে গিয়েছে পায়ে পায়ে। এক রিক্ততার হাড়-জিরজিরে অস্তিত্ব।
মেরামতি আর হবে না। কেমন করে হবে। সব অর্থ বাবা আর বোনের ওষুধে, ডাক্তারে এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে ফুরিয়ে যায়। এতটুকুও উদ্বৃত্ত নেই। বরং প্রতি মাসে টান পড়ে। প্রতি মাসে বিজ্ঞাপমেয় সংগ্রহ থেকে সরাতে হয়। আবার পরের মাসের মাইনে থেকে পুষিয়েও দিতে হয়। অভাবের চক্র তাই মাসে মাসে আবর্তনই করে।
তার মনে হয়, তারা প্রত্যেকেই এই বাড়িটারই মতো নোনাধরা, ফেটে যাওয়া, পলেস্তারা খসা মানুষ। তাদের বেঁচে থাকাটা নিতান্তই অর্থহীন। প্রাণ যেন ঝুলে রয়েছে গলায়। আরও কিছু বিপর্যয় এলেই দেহত্যাগ কবে।
দরজায় শব্দ করে সে, আর দরজা খুলে যায়। মা। বিরক্ত, অপ্রসন্ন মুখে ঝুলকালির মতো লেগে আছে প্রশ্নটা। লেগে আছে, কিন্তু উচ্চারিত হচ্ছে না। হবে না শুভদীপ জানে। রোজগার করে বলেই এই সংসার তাকে দেয় কিছু বাড়তি সুবিধা, সম্রম। কিছু বাড়তি গুরুত্বও, যা তার বাবা পেয়ে আসত আগে। কবে থেকে সে এই পদে অভিষিক্ত হল জানতেও পারেনি। সংসার প্রচলিত নিয়মে তাকে একটি পদমর্যাদা দিয়েছে। সে নিজে এই পদ বা মর্যাদা চায় কি চায় না সেটা কোনও কথাই নয়। পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের হাতে পায়ে অজস্র শিকল। ক খ-এর চেয়ে স্বাধীন। খ গ-এর চেয়ে। কিন্তু ক খ গ কেউ সীমাহীন স্বাধীনতা লাভ করে না। সম্পূর্ণ স্বাধীনতা নেই কোথাও, ছিল না কখনও। হবে কি না একমাত্র বলতে পারে মহাকাল। কিল মহাকালের সঙ্গে কথােপকথন করবে কোন শক্তিমান?