না। পারে না কখনও। চাইলেও সে নিজেই গররাজি হবে। কারণ ছেলেটি অর্থবান নয়। পাঁচশো টাকার জন্য যে দামাদামি করে সে কিছুতে অর্থবান নয়। আর সে চায় অর্থবান স্বামী। না হলে, সে জানে, বাজুদির মতো, বিয়ের পরেও তাকে নামতে হতে পারে আবার ব্যবসায়।
আবার ব্যবসা। মানে আবার বিবিধ যন্ত্রণা, উপদ্রব, ঘৃণা ও আশঙ্কা। চায় না সে। চায় না আর। এমনকী কারও রক্ষিতা হয়ে থাকতেও চায় না। চট করে, বেশি অর্থের লোভে বাইরেও যেতে চায় না। চেনাজানাদের চেয়ে তাই তার টাকা কম।
বেশি রোজগার করতে চাইলে অত ভয় থাকলে চলে না এ কথা বাচ্ছদি তাকে বহুবার বুঝিয়েছে। কিন্তু নিরঞ্জন জানা তাকে আজও আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে আছে।
দিঘা নিয়ে গিয়েছিল তাকে। নিরঞ্জন। নিরঞ্জন জানা। পাঁচ হাজারের চুক্তি। চার দিন তিন রাত্রি থাকা। মা তখন সদ্য এসেছে হাসপাতাল ফেরত। হাঁ-মুখ সংসারে টাকার গভীর আর্তি। পাঁচ হাজার টাকা তার লেগেছিল অপূর্ব আশীর্বাদ। সে গিয়েছিল সহজেই আর ফিরেছিল একরাশ যন্ত্রণা ও সংক্রমণ নিয়ে।
কোনও মানুষের যে এতখানি খিদে থাকতে পারে–সে জানত না। কিন্তু এইরকম, সারা দিনমান নিম্নাঙ্গসেবী মানুষ আর দেখেনি। নিরঞ্জনের ক্লান্তি নেই। সে তখন বার করত গাজর, মুলো, পটল, বেগুন এবং মোমবাতি। বিমুখ যযানি হয়ে যেত শুকনো খটখটে। দারুণ যন্ত্রণা হত। সে আপত্তি করেছিল। হাত পা ছুড়েছিল। নিরঞ্জন জানা তখন অরগা দুটি খাটের সঙ্গে বেঁধে ফেলে এবং প্রহারে ভরিয়ে দেয় গাল। শেষ দিন সে যন্ত্রণায় কঁকিয়েছিল সারাক্ষণ। কেঁদে ফেলছিল মাঝে মাঝে। নিরঞ্জন জানার দয়া হয়নি। প্রাপ্য বুঝে নিয়েছিল।
সাত দিন ঠিকমতো হাঁটতে পারেনি সে। বাদির কাছে গিয়ে আকুল কেঁদেছিল।
শরীরের লোভেই আসে, অথচ শরীরকে এতটুকু যত্ন করে না, সম্মান দেয় না, ভালবাসে না তারা। বুঝিয়েছিল বাজুদি। পৃথিবীতে শরীরই একমাত্র যাকে অর্থব্যয় করে অবহেলা ও অপমান করা হয়।
বাচ্চুদিই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। যে পাঁচ হাজার টাকা সে আয় করেছিল তার থেকে এক হাজার টাকা তার নিজেরই কিন্তু নেই। সে ঘন হয়ে যেত। নিরঞ্জন চিকিৎসায় ব্যয় হয়। তার ওপর পনেরো দিন টানা সে লোক নিতে পারেনি। রোজগার বন্ধ ছিল।
সেবার যখন সে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল বাবার হাতে, বাবার ঘোলাটে চোখে চকচকে ঝিলিক উঠেছিল। পরদিন সে যখন পাঁচশো টাকা চায় এবং তার পরদিন আরও পাঁচশো, বাবার কপালে তখন তীব্র কুটি। যেন দিয়ে দেওয়া টাকা চেয়ে অনধিকার চর্চা করছে সে। সে যে নিজের জন্য রাখেনি কিছুই, তার কোনও মূল্যই ছিল না।
বেশ্যাবৃত্তি সমাজের দৃষ্টিতে তার নারীত্ব নৈতিকতাকে খর্ব করেছে। তাই, তার আর সব মানবিক গুণগুলি সম্পর্কেও সকলেই অন্ধ। সেগুলো আছে কিন্তু নেই হয়ে আছে। কারণ নারী যখন স্বদেহ বিক্রয় করে তখন ভোগ্যপণ্য ক্রয় নিমিত্ত সমাজ বহু প্রতিনিধি পাঠায়। একবার বিক্রি হয়ে গেলে নারী আর মানুষ থাকে না।
পুরুষেরা চিরক্রেতা। কেনে। খায়। সমাজ বানায়। নারী মানে। মেনে নেয়। রীতিনীতি শাসন-শোষণ স্কন্ধে নারী হয় সমাজধারিণী।
সেদিন, বাবার কুটি দেখে তার কান্না পেয়েছিল। সেই প্রথম, তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। পরিবারে সে এক উৎপাদন যন্ত্রবৎ। অর্থ। যদি অন্য কোনও সম্মানীয় উপায়ে এই অর্থ এসে যায়, ধরা যাক তার ভাই একটি চাকরি পেল সঙ্গে সঙ্গে এ বাড়িতে সে অচ্ছুকন্যা হবে।
সে জানে, নগরনটীদের নিয়ে, গণিকা, বেশ্যা, উর্বশী, রম্ভা, মেনকা, মালবিকাদের নিয়ে এখন তুমুল আন্দোলন। শ্রমিকের সম্মান দিতে হবেদাবি। স্বাস্থ্যের অধিকার দিতে হবে–দাবি। সমাজের এক কোণে নয়–তারা মধ্যমণি হবে। যারা গায়ে ঢাকা দিয়ে গণিকালয়ে যায়, তাদের গৃহের পাশে মুখ তুলে দাঁড়াবেই গণিকার বাড়ি। আরও—আরও–আরও কিছু।
হাক্—থু! থুঃ থুঃ!
সে মানে না এসব। হবে না। হবে না কিছুই। কুরং স্বীকৃতি পাবার মোহে দলে দলে নেমে আসবে অভাবী মেয়েরা। উদ্বৃত্ত আয়ের লোভে মধ্যবিত্ততার সীমিত সামর্থ্য থেকে আরও—আরও—আরও পেতে গৃহবধূ রাস্তায় দাঁড়াবে। আরও বেশি শোষণের জাল নেমে আসবে শ্রমিকের স্বীকৃতিবেশে।
হ্যাঁ। মানে সে। লোকালয়ে বসবাস মানে। আলাদা থাকবে কেন? অস্পৃশ্য থাকবে কেন গণিকার দল?
সম্মেলনে গেছে সে কয়েকবার উত্তেজিত দাবি-দাওয়া বিতর্কের পর হাজার গণিকার মধ্যে মঞ্চের মুখাপেক্ষী বসে থেকে ভেবেছে—দাবি হোক একটাই–পৃথিবী হোক এমনই সমৃদ্ধ যাতে গণিকাবৃত্তি লুপ্ত হয়ে যায়।
দেওয়াল ঘড়িটা একবার দেখে নেয় সে। সময় আছে। আরও একবার রাস্তায় যাওয়া যেতে পারে। আগরাত্রে খদ্দের পেয়ে যাওয়ায় তার আজ আরও রোজগারের সম্ভাবনা।
টেবিলের ড্রয়ার থেকে খাতা টানে সে। ছেলেটি শার্টের বোতাম আঁটছে। এলোমেলো চুল আঙুলে সাজিয়ে নিল। এখনও অন্যমনা। চশমাটা পরে নিল এবার। সে নাম চাইল। জিজ্ঞাসায় অনুরোধ মেখে। ছেলেটি থমকাল একটু। হয়তো অবাক হল। কিংবা ভয় পেল মনে মনে।
সে জানে, সকলে সঠিক নাম জানায় না তাকে। কিছু এসে যায় না তার। সে শুধু একটা নাম চায় নাম।
এমনও হয়েছে, সে দেখেছে এমন যে একই ব্যক্তি ঘুরে ফিরে এল তার কাছে। একই লোক। সে চেনে। চিনে ফেলে। লোকটিও কি চেনে না তাকে? চেনে। কিন্তু চেনা দেয় না বেশির ভাগ। চলতে থাকে ভানের লড়াই। সে তখন নাম জানতে চায়। হতে পারে একই নোক দু’রকম নাম বলল। হতে পারে। হয়ে থাকে। সে সবসময় বুঝতেও পারে না। মুখ মনে থাকে তার। কিন্তু বেশির ভাগ নাম ভুলে যায়।