ততদিনে চিনেছে অনেক। দেখেছে প্রচুর। যারা আসে, তাদের সকলেরই অভাব নেই তার মতো। কিন্তু অভাব তাদের মনে। তাদের আরও-চাই মিটবে না কোনও দিন। মেটাবেনা জগতের লোভের উৎসার।
বাড়ির বউ আসত। কলেজ পড়ুয়া মেয়ে আসত। পুরুষ আসত যারা—সব ধনবান, প্রতিষ্ঠিত, ক্ষমতাশালী। তবু, ক্ষমতার পাশ দিয়ে পিপড়ের সারির মতো সরু হয়ে লেগে থাকে অক্ষমতা। একদিন তাকে চিহ্নিত করে ফেলে আরও আরও ক্ষমতার হাত। আর ধাবমান হয়। অক্ষমতার সরু ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে ন্যায়দণ্ড। আর, অন্য অনেকের সঙ্গে সে-ও ধরা পড়ে যায়।
এইসব কাহিনি তার। বলতে বলতে রাত ভোর হয়ে যাবে। সেই মানুষটা সারা রাত জেগে জেগে শুনবে তার কথা। তারপর একে বুকে টেনে নেবে। তার কষ্টে কষ্ট পেয়ে শূন্যতা ঢেকে দেবে পলাশ-গোলাপো। ঘরবর পাবে সে। সিঁদুরে সীমন্তিনী হবে। একদিনও পিলখবে না তখন। সন্তানের জন্ম দেবে।
তার একটি খাতা আছে। সমস্ত পুরুষ—যাবৃতর দেহ ক্রয় করে, সে লিখে রাখে নাম। শুধু নাম। কেন রাখে, জানে না সে। সংসারের যে স্বপ্ন তার—পেয়ে গেলে সেইসব, সে এই খাতা ছিঁড়ে ফেলে দেবে। ইতু, মঙ্গলচণ্ডী, সন্তোষী ব্ৰতর মতো নামব্রত তার। আর এইভাবে তার জমে গেছে একান্ন জন অমল, তিয়াত্তরজন দীপক। দশজন হরিবাবু। এই দশজনের মধ্যে আছে হরিপদ, হরিমাধব, হরিসাধন, হরিপ্রসাদ, হরিশঙ্কর, হরিবিষ্ণু, হরিবন্ধু… ইত্যাদি সব নাম। দুজন কালীকিঙ্কর আছে, একজন মাত্র আছে সুবলসখা। এবং আরও আছে। আরও। সে মাঝে মাঝে সংগোপনে এই নামাবলির পাতা ওল্টায় আর ভাবে—আরও কত নাম হবে? কত নাম? থামবে না? কোনও দিন থামবে না?
অতি সংগোপনে সে রেখে দিয়েছিল আরও কয়েকটি জিনিস। একটি কলম। কলেজের বই আর খাতা। পাতার মধ্যে অধ্যাপকদের বক্তব্য তুলে রাখা। উই সেগুলি ধ্বংস করেছে।
যদিও এখন আর সে কাঁদে না তেমন। ইচ্ছে করলেও মনে হয় কান্না তাকে ছেড়ে গিয়েছে কবেই। যেমন আত্মীয়-পরিজন, ছোটবেলার প্রিয় মামা-মামি, মিষ্টিকাকু আর ইতিকাকি, যেমন একই বাড়িতে থাকা এবং তারই অন্নে প্রতিপালিত হওয়া ভাই! ছেড়ে গেছে। সকলেই ছেড়ে গেছে তাকে। সংক্রামক ব্যাধি লাগা ছোট গ্রামটির মতো। ছেড়ে গেছে এমনকী বাবা-মাও। সে যদি চলে যেত অন্য কোথাও, ধরা যাক নামকরা বেশ্যাপাড়ায়, আর ঘরভাড়া নিত, মাসে-মাসে টাকা পাঠাত শুধু—তবে বেঁচে যেত বাবা-মা। বেঁচে যেত ভাই। অন্তত লোককে তো বলা যেত–অসভ্য মেয়েটিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
কেউ কারও নয়। এ-জগতে শেষ পর্যন্ত কেউ কারও নয়। স্বার্থে টান পড়লে নাড়ির বন্ধনও খুলতে খুলতে ন্যাড়া। কিন্তু যাবে না সে। বেশ্যাপাড়ায় যাবে না। বুক খুলে সারি সারি দাঁড়াবে না গোরু-ভেড়াছাগলের মতো। হ্যাঁ, সে নিজেকে বিকোয়। বিকোয় অপারগ হয়ে। নিরুপায় হয়ে। বিকোয় কেন-না সে যদি মনোহারী দোকানের কর্মচারী হত-এমন একটি কাজ সে পেয়েছিল সঙ্কটের কালে—তুকে যা মাইনে পেত তাই দিয়ে সংসারের ভরণ, পোষণ, পুষ্টি, ওষুধের দাম তো দূরের ব্যাপার, সারা মাসে শুধু আলু আর চালও জুটত না।
জুটিয়েছে সে। নিজেকে মেরে, পুড়িয়ে ভেঙে বাঁচিয়েছে বাবা-মা-ভাই। বাঁচিয়েছে। ওরা তার নিজেরই তো সে তো চায় বাবা সুস্থ হোক, মা সুস্থ হোক, ভাই গড়ে তুলুক জীবনকে সুন্দর। তার তো অধিকার আছে চাইবার। অধিকার আছে এই ভাঙাচোরা বাড়িটাতে থাকবার। তার জন্মগত অধিকার। কিন্তু সে জানে, জম্মগত অধিকারের মূল ছিন্ন করে দিতে পারে পরিবেশ পরিস্থিতির দুর্মর শক্তি। সে জানে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে থেকে যেতে চায়। অর্থ অশুচি হয় না। দেহব্যবসায়ের জন্য সে ঘৃণ্য কিন্তু অর্থ নয়। এ বাড়িতে ব্যবসা করলে তার দেহমন্দির পরিত্যাজ্য, গৃহমন্দির অপবিত্র কিন্তু টাকাপয়সা গঙ্গাবারি।
তিক্ত লালায় ভরে যায় তার মুখ। রাগ-রোষ-দুঃখ আর হতাশায় স্পষ্ট হয়ে সে নিজের হাতে হাত বোলায়। ভালবাসে সে। এই হাত, এই বুক, এই শরীরের প্রত্যেকটি কোণ সে ভালবাসে। প্রত্যেকটি প্রান্ত। যেমন সে ভালবাসে বাড়ি। এই ভাঙাচোরা বাড়ি। ভালবাসে ভাই। ভালবাসে বাবা-মা। ভালবাসে।
ভালবাসা। এখনও গেল না তার। এখনও তা লটকে রইল স্বপ্নে ও দুঃস্বপ্নে। ভালবাসা শেষ হলে, ফুরিয়ে গেলেই, সে তখন একটু একটু করে খুলে খুলে ফেলে দেবে হাড় রক্ত অস্থি মজ্জা মাংস।
ভালবাসা এই ছেলেটির মধ্যে কোথাও সংগোপনে রাখা আছে ভালবাসা, বুঝেছে সে। প্রাথমিক জড়তার পর সে যখন ধারে ধীরে শরীরে আসছিল, তখন, যেভাবে চুম্বন করছিল গালে ও কপালে, বন্ধ করে চোখ, যেভাবে আলতো হাত বুলিয়েছিল নাভিতে আর গহন অরণ্যময় গিরিখাত গভীরতায়, যেভাবে ঠোঁটের নরম দ্বারা চেপেছিল স্তনবৃন্ত–তাতে তার বার বার মনে হয়েছিল, এক শরীরে শুয়ে অন্য কোনও শরীরকে সে মনে মনে ডাকছে।
তার ভাল লাগছিল খুব। আবেশ। গভীর আবেশ। ছেলেটি তার আঙুলের পরিচালনে এই বহুজনে অভ্যস্ত শরীরকে দিয়েছিল অপূর্ব তরঙ্গরেখা। সে চুরি করে ভালবাসা নিচ্ছিল তখন। রাহাজানি ছিল। সে জানে, চূড়ান্ত খরিদ্দার, বেশ্যার শরীরে ভালবাসা আঁকে না কখনও। তারা উচ্ছল সুখ আঁকে, বিষণ্ণ আঁচড় আঁকে, যন্ত্রণার কামড় একে দাগ করে দেয়। কিন্তু ভালবাসা আঁকে না ভুলেও।
অভ্যস্ত ছেলেটি। বুঝেছিল সে। ভাবছিল, এই কি হতে পারে, তার স্বপ্নের কুমার?