প্রাথমিকভাবে তার মনে হয়েছিল, এই আঘাত মৃত্যুর মতো। সাময়িকতার এই কষায় স্বাদ ক্ষণিক উপভোগ্যতার সঙ্গে মিশে বিশ্রী ও কটু হয়ে উঠেছিল। সব মিলে, সত্যি, মরে যাচ্ছে এমন যন্ত্রণা। তার সেই মুহূর্তে অভিলাষ ছিল, ইস্কুলের সামনেই, পথ পেরুতে সে গাড়িচাপা পড়ুক আর তার দলাপাকানো বা ছিন্নভিন্ন মাংসাদি দেখে সারাজীবন অনুশোচনায় দন্ধে মরুক মালবিকাদি।
কিন্তু বাস্তবিক সে গাড়িঘোড়া দেখে, সামলে, অত্যন্ত সাবধানেই রাস্তা পার হয় এবং নিজেকে অক্ষত আবিষ্কার করে।
সে চলে আসবার আগে শুনতে পেয়েছিল, মালবিকাদি তাকে সব ভুলে মন দিয়ে পড়াশুনো করার উপদেশ দিচ্ছে। মনে মনে সে ‘খানকি’ কথাটি উচ্চারণ করেছিল তখন এবং সাময়িকতার এই দাহে বহুদিন তাড়িত হয়েছিল। তৃতীয় বর্ষের শেষ পরীক্ষায় তার ফল খারাপ হয়। কিন্তু শ্যামলিম বিপদাপন্নতার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় ঠিক।
মালবিকাদিকে তার মনে হয়েছিল প্রতারক। এই প্রতারণা যখন সে নিজেই অভ্যাস করে তখনও এমনকী মালবিকাদিকে সে ক্ষমা করেনি। এবং আর কখনও যায়নি সে মালবিকাদির কাছে। কিন্তু কোনও কোনও রাত্রে মালবিকাদিকে সে রমণ করেছে দীর্ঘ-দীর্ঘ সময় ধরে। শরীর জাগিয়ে দিয়ে পালিয়ে যাওয়া নারীকে সে প্রায় ধর্ষণ করেছে এবং নিজেকে মুক্ত করেছে একাকী। ঠিক যেমন এখন সে চন্দ্রাবলীকে ভাবে আর বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত হয় আর ছটফট করে। ছটফট করে আর… না। এই মুহূর্তে চন্দ্রাবলীকে ভাবতে চায় না সে। বরং মালবিকাকে অনুগমন করে।
মালবিকা। মালবিকার পর মালবিকা। আজকের মালবিকার পর আরও কোনও মালবিকা আসবে কি তার জীবনে? সে জানে না। প্রথম মালবিকার সঙ্গে সে গহ্বরে নেমেছিল। আজ অতলে যাবে। সেই অতলকে সে এখন দারুণ ভাবে কামনা করছে। আলো-ছায়া পেরিয়ে, যানবাহন টপকে, সে মালবিকার সঙ্গে সঙ্গে পোঁছচ্ছে এক সরু গলির ভেতরকার পুরনো বাড়ির একতলায়। এ বাড়ির অবস্থা তাদের বাড়ির চেয়েও খারাপ। পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে। ইটের গায়েও লেগে গিয়েছে ক্ষয়। জানালা কজা থেকে ছুটে কাত হয়ে আছে। ভারী কাঠের ভার আর বইতে পারছে না পুরনো লোহার জংধরা টুকরো।
প্রবেশপথে টিমটিমে বাতি। দরজায় জানালার মতোই ভারী, কাঠের পুরনো পাল্লা। সেই দরজার আবেদন এত গম্ভীর যেন ভীমপ্রতিন্দ্রায় প্রবেশ ও প্রস্থান সম্পর্কে রক্ষণশীল।
মালবিকা দরজায় আলতো টোকা মারে আর দরজা খুলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কে যেন দ্রুত পায়ে চলে যায়। শুভদীপ দেখতে পায় কেবল এক অপস্রিয়মাণ প্রলম্বিত ছায়া। সে থমকে দাঁড়ায়।মালবিকা তার হাত ধরে একটি ঘরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। বন্ধ করে দেয় দরজা। বাতি জ্বালে এবং শুভদীপ কিছু বোঝার আগেই এক টানে কামিজ অপসারিত করে। শুভদীপের দু’হাতে নিজেকে জড়িয়ে পিঠের দিকে নিতে নিতে অন্তর্বাস খুলে দেবার তাগিদ দেয়। শুভদীপের গলা শুকিয়ে কাঠ। সে কোনওক্রমে, কেবল বলতে পারে, তার জল চাই। সবার আগে এক গেলাস বিশুদ্ধ পানীয় জল।
টেবিলে জলভর্তি প্লাস্টিকের বোতল রাখা ছিল। বাঁ হাতে এগিয়ে দেয় মালবিকা। ডান হাত পেতে দেয় প্রাপ্য অর্থের জন্য।
০৩. এই বয়সের পুরুষ যত জন আসে
এই বয়সের পুরুষ যত জন আসে, বেশিরভাগেরই তেমন অভিজ্ঞতা থাকে না দেখেছে সে। তারা আসে, দরজা বন্ধ হতেই খুলে ফেলে পোশাক। আর তাড়াহুড়ো করে সঙ্গমে পৌঁছে যায়। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে জানে না আনন্দ, জানে না উপভোগ। শুধু ভোগ জানে। যেহেতু অর্থের বিনিময়ে আসে সেহেতু অজ্ঞতার সঙ্গে লিঙ্গ মিশে এক ধরনের ক্ষুধা মেটাবার জান্তবতাই শুধু প্রকাশ পায়। যতখানি পারে, মাংস ঘাঁটা শুধু।
যখন তার সঙ্গে মধ্যবয়সী নয়, বৃদ্ধ নয়, শুধু কোনও যুবকের দেওয়ানেওয়া হয়, তখন সে সুখ প্রার্থনা করে। কামনা করে উপভোগ্য। পেশাদারিত্বের বাধ্যতামূলক দেহদানের যন্ত্রণার বাইরে শৈল্পিক কামকলার আনন্দ পেতে ইচ্ছে করে তার।
কাম বহু ব্যবহারে ক্লিষ্ট হলে পাঁকের মতো উঠে আসে যন্ত্রণা কেবল। বাচ্চুদি বলে, দশ বছর এরকম চললে সে আর আনন্দ প্রার্থনা করবে না। সে তখন সঙ্গম করতে করতে হয়তো-বা এক গামলা বমি করবে মনে মনে। কিংবা চিতাকাঠ কল্পনা করে ভুলে যেতে চেষ্টা করবে পুরুষটির দুর্গন্ধ শাসবায়ু। অথবা হিসেব করবে, দিনে আর কতজনকে টানতে পারলে বছরের শেষে একখানি বাতানুকূল যন্ত্র লাগিয়ে ফেলা যায়।
সম্ভব। এমনই হওয়া সম্ভব। বাচ্চুদির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। সুখের কাঙাল বাচ্চুদিও হয়তো ছিল তার মতো বয়সে।
মাঝে মাঝে কল্পনা করে সে। এক রাজপুত্র এসে যাবে একদিন আর তার প্রেমে মুগ্ধ হবে। কোলে মাথা রেখে সারাজীবনের কাহিনি শুনতে চাইবে তার। সে চোখের জলে ঠোঁট নোত করে বলবে সমস্ত কথা। বলবে মায়ের পঙ্গুত্ব। বাবার মানসিক রোগগ্রস্ত হয়ে পড়া। ভাইয়ের অসহায় শৈশব। বলবে, অর্থের প্রয়োজনের কথা বলতে কলেজের এক বান্ধবী কীভাবে তাকে স্তোক দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল মধুচক্রে।
হ্যাঁ, সে বেরিয়ে আসার চেষ্টাও করেছিল। মানাতে পারেনি সেখানে। টাকা পেয়েছিল অনেক। কিন্তু শরীরে লেগে থাকা ক্লেদ মুছে ফেলতে পারেনি। সারাক্ষণ গায়ে ঘৃণা গিশগিশ করত।
তাদের অভাবের সংসারে একের পর এক অমঙ্গল আছড়ে পড়ছে যখন, আত্মীয়রা গুটিয়ে যায় যে-যার নিজস্ব খোলে। তখনও ন্যায় ছিল অন্তরে। নীতি ছিল। মধুচক্রের অর্থে অভ্যস্ত হয়ে যেতে থাকা সংসার মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে ফের বাঁচার আকুলতায়। তার মায়া হয়। নিজের চেয়ে অনেক বেশি বাবা-মা-ভাইয়ের জন্য। মায়াবশে মধুচক্র ছেড়ে দেবার ইচ্ছা নিয়েও সে কাটিয়ে দেয় দু’বছর।