তার বাবার এই ওষুধ তাদের এলাকায় পাওয়া যায়নি। দুদিন এমনিতেই কেটে গেছে তাই। সে ভেবেছিল একশো টাকার সঙ্গে বাড়তি কুড়ি টাকা যোগ করে মোট ছ’টি ওষুধ কিনে নিয়ে যাবে। কারণ একএকটি ট্যাবলেটের দাম আঠারো টাকা উনিশ পয়সা।
হবে না। ওষুধ কেনা হবে না আজ। সে মনে-মনে কথা সাজায়। একশো টাকার হিসেব তৈরি করে নিতে চায়। মাকে বলতে হবে। যদিও, যত যুক্তিসঙ্গতই হোক, মা গ্রাহ্য করবে না। অভিযোগ করবে। অভিযোগ, অভিযোগ, অভিযোগ।
মেয়েটি আলো-আঁধারি পেরিয়ে যাচ্ছে। সেও যাচ্ছে। আর পেরিয়ে যেতে যেতে জেনে যাচ্ছে মেয়েটির নাম মালবিকা।
মালবিকা? সে চমকে উঠছে। তার জীবনের প্রথম নারীর নাম মালবিকা। মালবিকা সিনহা। সে ডাকত মালবিকাদি। কারণ সে ছিল অন্তত বারো বছরের বড়। অপার সৌন্দর্যের ওপর মেদের প্রলেপ পড়ছিল তার তখন। অল্প পরিচিতি ছিল আগে। স্কাউটের সমাবেশে সেই পরিচয়ে গাঢ়ত্ব জমে। এবং একদিন মধ্যরাতে তাঁবু থেকে তাকে ডেকে নেয় মালবিকাদি। এবং তাঁবুগুলির পেছন দিকে, অল্প দুরে, একটি পাইনাসের তলায় তার ঠোঁট পুড়িয়ে দেয়।
সেদিন সে শরীরের স্বাদ জেনেছিল প্রথম। ভরাট স্তনের ওপর হাত রাখার অসম্ভব উত্তেজ সে অনুভব করেছিল প্রথম। মালবিকাদি ঘাসের ওপর শুয়ে, অভিজ্ঞ হাতে তাকে শরীরে নিয়েছিল। একুশ বছর বয়স তখন তার। সে তীব্র আকাঙ্ক্ষায়, উন্মাদনায়, উত্তেজনা ও উদ্বেগে, প্রথম নারীভেদের পুলকে ও সীমাহীন অনভিজ্ঞতায় ঘটিয়ে যাচ্ছিলসংঘর্ষ। সে টের পাচ্ছিল, ঘাস ও মাটির ঘর্ষণে তার হাঁটু ছড়ে যাচ্ছে। দুই হাঁটু ছড়ে যাচ্ছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না শুভদীপ এই প্রথমবার।
ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে। কিন্তু পরের রাত্রে আবার জেগে উঠেছিল আহ্বানের প্রত্যাশায়। প্রথম বিদীর্ণ করার কারণে তার ব্যথা জমেছিল। এমনকী মূত্রত্যাগ করার সময় জ্বালা। সুখমিশ্রিত সেই ব্যথাবেদনাকে, জ্বালাপোড়াকে সে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছিল বারবার।
মোট দশদিনের সমাবেশে সে মালাবিকাদির সঙ্গে মিলিত হয়েছিল তিনরাত্রি। এবং তাকেই নির্বাচন করার জন্য অসহ পুলকে ও গর্বে সে আপ্লুত ছিল সারাক্ষণ।
সমাবেশ থেকে ফিরে আসার পর এমনই এক প্রাক্ শীতের বিকেলে শ্যামলিম তাকে একটি গল্প শোনায়। মধ্যরাতে তাঁবু থেকে বেরিয়ে অভিসারের গল্প। আর সেই গল্প শোনাতে শোনাতে শ্যামলিমের মুখ গনগনে হয়ে যায়। কানে আগুন ধরে। চোখ থেকে হীরকদ্যুতি ছিটকোয়। জিভ হয়ে যায় আদ্যন্ত লালাসিক্ত। আর সেই সিক্ত জিভ অবিকৃত বর্ণনা দেয় যে শরীরের তার নাম মালাবিকাদি।
কথা বলতে বলতে শ্যামলিম একসময় মোট চার রাত্রি অভিসারের স্মৃতিবন্ধে ডুবে যায়। সে বোঝে। বুঝতে পারে। কারণ শ্যামলিমও তারই মতো একুশ। তারই মতো প্রথম। কৌমার্যের ডিম ফুটে বেরিয়ে আসা পুরুষছানা। কিন্তু সে নিজের তরফ থেকে একটি বর্ণও শ্যামলিমকে বলে না। বলতে পারে না। শ্যামলিম আহত হবে বলে নয়। সে প্রকৃতপক্ষে গোপন করতে চায় আপন রক্তক্ষরণ। চোখে জল এসে গিয়েছিল তার। প্রথম প্রতিক্রিয়ায়। যেন তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে। যেন কথা, রাখেনি মালবিকাদি তার।
এরপর প্রতিক্রিয়ার দ্বিতীয় স্তরে তার গা রি-রি করে। রাগে। অপমানো কিছু বা ঈর্ষায়। কারণ শ্যামলিম গিয়েছিল চারদিন। সে তিনদিন। নির্বাচিত হওয়ার শ্লাঘা থেকে চ্যুত হয়েছিল সে। এবং ছটফট করতে করতে পরদিন ছুটে গিয়েছিল মালবিকাদির ইস্কুলে।
মালবিকাদি বিরক্ত। অপ্রস্তুত। তাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। শুভদীপের চোখে পড়েছিল, সমাবেশে থাকাকালীন ছিল না, কিন্তু এখন মালবিকাদির সরু সিথি বরাবর সিঁদুর আঁকা। তার হঠাৎ চোখে জল এসে যায়। সে তেমনই অকস্মাৎ মালবিকাদির হাত ধরে স্থানকাল রির্বেচনা না করেই এবং শ্যামলিম প্রসঙ্গ টেনে তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকার কৈফিয়ত চায়।
মালবিকাদিকে তখন দেখাছিল কুদ্ধ ও বিপন্ন। একটানে হাত হিচড়ে ছাড়িয়ে নিয়েছিল সে। হিসহিস স্বরে তাকে বদমায়েশি করার চেষ্টা করতে বারণ করেছিল। তারপর স্থির তাকিয়েছিল তার দিকে। মুখের রেখায় বা দৃষ্টিতে একবিন্দু প্রশ্রয় ছিল না। বরং তার কাঠিন্যের অভিব্যক্তিতে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছিল শুভদীপ। আর মালবিকাদি কেটে কেটে তার বক্তব্য পেশ করছিল। বুঝিয়ে দিচ্ছিল, পারস্পরিক সম্মতিতে রচিত কিছু উপভোগ্যতা ছাড়া এই সংযোগের কোথাও কোনও প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, প্রতিশ্রুতি বা দায়বদ্ধতা ছিল না। তারা কেউ কারওকে কোনও কথা দেয়নি। ওই তেরাত্রির ঘনিষ্ঠতার মধ্যে, কামাদির মধ্যে কোনও বিশ্বাসঅবিশ্বাস, ন্যায়-অন্যায় ছিল না। এমনকী শুভদীপ নিজেও কোনও মেয়ের সঙ্গে ব্যাপৃত হলে মালবিকাদির কিছু যেত আসত না। এতটুকু বিচলিত হত না সে। এইসব সম্পর্ক যেখানে শুরু হয়, সেখানেই শেষ হয়ে আসে। সাময়িক জীবনের সাময়িকতর লীলাখেলা। খুচরো পয়সার মতো। ছোটখাটো ক্রয়ে মাত্র কাজে লাগে। কিংবা প্রাতরাশ, মধ্যাহ্নভোজন ইত্যাদির বাইরে পাঁচ টাকার ফুচকা খাবার মতো। পুষ্টির পরোয়া নেই। শুধু স্বাদ।
সম্পর্ক মানেই এক বিশ্বাস ও দীর্ঘস্থায়ী ন্যায়পরায়ণতা–এমনই বোধ ছিল শুভদীপের। কেউ কারওকে শরীরীভাবে আহ্বান করেছে মানে সে মানসিক অভিষেক ঘটিয়ে দিয়েছে। যে আহ্বান করেছে তার মনের মধ্যে, যাকে আহ্বান করা হয়েছে তার আসন অবিচলিত। এমত ধারণা ও বিশ্বাস সমূহে তাড়িত সে ন্যায়বান হয়ে উঠতে চেয়েছিল তর্ক দ্বারা। মালবিকাদি তাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়। সে তখন প্রভূত আবেগে, প্রভূত বেদনাবোধ ও অপমানে সরাসরি কেঁদে ফেলে রাস্তায়। চোখ থেকে নেমে আসা জল কান্নার দমকসহ মুছে নেয় হাতের উল্টোপিঠে। এবং ধাক্কা সামলাতে সামলাতে রাস্তা পার হয়।