ক্ষতি নেই, বলিস কি তুই? রায়-বাবুরা যে হাসবে, বলবে, বাড়ির বউ হয়ে চাষা প্রজাদের সঙ্গে কথা কইলে!
বলুক গে। তাই বলে ওরা ওদের দুঃখের কথা বলতে এলে শুনবে না? আর, এমনধারা মুসলমান নবাববাড়ির মত পর্দার দরকারই বা কি? আজকাল মেয়েরা দেশের কাজ করছে! ইউরোপে–এই যুদ্ধে–
বাধা দিয়া মা হাসিয়া বলিলেন, তোর মাস্টারিতে আর আমি পারি নে অহি। তা তুই নিজে শুনে যা বলতে হয় বল না; সেইটেই আমার বলা হবে। আমি মহীকে বলব, আমিই বলেছি এ কথা।
ছেলে জেদ ধরিল, না, সে হবে না, তোমাকেই শুনতে হবে। আমি বরং দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব। ওরা বাইরে থাকবে, তুমি ঘরে থাকবে।
শেষে তাহাই হইল। অহীন্দ্রকে মধ্যে রাখিয়া সুনীতি প্রজাদের অভিযোগ শুনিতে বসিলেন। তাহারা আপনাদের যুক্তিমত দাবি জানাইয়া সমস্ত নিবেদন করিল, প্রকাশ করিল না শুধু ইন্দ্র রায়ের নিকট শরণ লইতে যাওয়ার কথা এবং রায়-মহাশয়ের সুকৌশল প্রত্যাখ্যানের কথা। তাহারা বক্তব্য শেষ করিয়া বলিল, আপনার চরণে আমরা আশ্রয় নিলাম মা, আপনি ইয়ের ধর্মবিচার করে দ্যান। কালীর গেরাসে আমাদের সবই গিয়াছে মা, আমাদের আলু লাগাবার জমি নাই, আখ লাগাবার জায়গা নাই, আর কি বলব মা,–চাষীর বাড়িতে ছোলার ঝড় ওঠে না গম ওঠে না। আমরা তবু তো কখনও খাজনা না-দেওয়া হই নাই।
সুনীতি বলিলেন, তোমরা বরং ও-বাড়ির দাদার কাছে যাও। অহিকে তোমাদের সঙ্গে দিচ্ছি। ও-বাড়ির দাদা অর্থে ইন্দ্র রায় মহাশয়। প্রজারা ইন্দ্র রায়ের নাম শুনিয়া নীরব হইয়া গেল। রংলাল চট করিয়া বুদ্ধি করিয়া বলিল, আজ্ঞে না মা, উনি জমিদার বটেন; কিন্তু বুদ্ধিতে উনি জেলাপির পাক। যা করতে হয় আপুনি করে দ্যান।
সুনীতি বলিলেন, ছি বাবা, এমন কথা কি বলতে হয়। তিনিই হলেন এখন গ্রামের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। এ বাড়ির মালিকের অসুখের কথা তোমরা তো জান! মহী হাজার হলেও ছেলেমানুষ। আমি স্ত্রীলোক। সমস্ত গ্রামের জমিদার নিয়ে যে বিবাদ, তার মীমাংসা কি আমার দ্বারা হয় বাবা? যদি কখনও ভগবান মুখ তুলে চান, মহী অহি উপযুক্ত হয়, তবেই আবার তোমাদের অভাব-অভিযোগের বিচার এবাড়িতে হতে পারবে। এখন তোমরা ও বাড়ির দাদার কাছেই যাও। অহি তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছে।
প্রজাদের মধ্যে রংলালই আবার বলিল, আজ্ঞে মা, তিনিও খামচ তুলেছেন। সেই তো আমাদের ভয়, নইলে অন্য জমিদারের সঙ্গে লড়তে আমাদের সাহস আছে। না হয় দশ টাকা খরচ হবে।
সুনীতি বলিলেন, তিনিও কি চরটা দাবি করেছেন না কি?
মুখে বলেন নাই, কিন্তু ভঙ্গী সেই রকমই বটে। গাঁসুদ্ধ জমিদারই দাবি করেছে মা, আমরাও দাবি করছি, আবার মহাজনেরাও এসে জুটেছে। দাবি করেন নাই শুধু আপনারা। অথচ–
অথচ কি মোড়ল? ওতে কি আমাদেরও অংশ আছে?
বার বার হতাশার ভঙ্গীতে মাথা নাড়িয়া রংলাল বলিল, কি আর বলি মা? আর বলবই বা কাকে? আইনে তো বলছে, চর যে-গাঁয়ের লাগাড় হয়ে উঠবে, সেই গাঁয়ের মালিক পাবে। তা চরখানি তো রায়হাটের সঙ্গে লেগে নাই। লেগে আছে উ-পারের চক আফজলপুরের সঙ্গে। তা আফজলপুর তো আপনাদেরই ষোল আনা। আর ই-পারে হলেও তো তারও আপনারা তিন আনা চার গণ্ডার মালিক।
অন্য প্রজারা রংলালের কথায় চঞ্চল হইয়া উঠিতেছিল। মানুষ বৃদ্ধ হইলে ভীমরতি হয়, নহিলে দাবি জানাইতে আসিয়া এ কি বলিতেছে বুড়া। সুনীতি একটু আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, দেখ বাবা, তোমার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তোমরা দাবি করছ চর তোমাদের প্রাপ্য, এপারে কালী নদীতে জমি তোমাদের গেছে, ওপারের চরে সেটা তোমাদের পেতে হবে। আবার–
মধ্যপথেই বাধা দিয়া লজ্জিতভাবে রংলাল বলিল, বলছি বৈকি মা, সেটা হল ধর্মবিচারের কথা। আপনি বলেন, ধৰ্ম অনুসারে আমাদের পাওনা বটে কি না?
সুনীতি নীরবেই কথাটা ভাবিতেছিলেন, পাওয়া উচিত বৈকি। দরিদ্র চাষী প্রজা– আহা-হা!
রংলাল আবার বলিল, আর আমি যা বলছি–ই হল আইনের কথা। আইন তো আর ধন্মের ধার ধারে না। উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোই হল আইনের কাজ।
সুনীতি ধীরভাবে চিন্তা করিয়া শেষে বলিলেন, আচ্ছা, আজই আমি মহীকে আর মজুমদার ঠাকুরপোকে আসতে চিঠি লিখে দিচ্ছি। তাঁরা এখানে আসুন। তারপর তোমরা এস। তবে একথা ঠিক, তোমাদের ওপর কোন অবিচার হবে না।
রংলাল আবার বলিল, শুধু যেন আইনই দেখবেন না মা, ধম্মপানেও একটুকুন তাকাবেন।
সুনীতি বলিলেন, ধর্মকে বাদ দিয়ে কি কিছু করা যায় বাবা? কোন ভয় নেই তোমাদের।
প্রজারা কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া চলিয়া গেল।
সুনীতি বলিলেন, তুই ওবেলা একবার ও-বাড়ির দাদার কাছে যাবি অহি।
.
০২.
সুনীতি রায়-বংশের ছোট বাড়ির মালিক ইন্দ্র রায়কে বলেন–দাদা। কিন্তু ইন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাহার কোন সম্পর্ক নাই। ইন্দ্র রায় রামেশ্বর চক্রবর্তীর প্রথমা পত্নী রাধারাণীর সহোদর। চক্রবর্তী-বংশের সহিত রায়-বংশের বিরোধ আজ তিন পুরুষ ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে; রায় বংশের সকলেই চক্রবর্তীদের প্রতি বিরূপ, কিন্তু এই ছোট বাড়ির সহিতই বিরোধ যেন বেশী। তবুও আশ্চর্যের কথা, রামেশ্বর চক্রবর্তীর সহিত ছোট বাড়ির রায়-বংশের কন্যার বিবাহ হইয়াছিল।
তিন পুরুষ পূর্বে বিরোধের সূত্রপাত হইয়াছিল। রায়েরা শ্রোত্ৰিয় এবং চক্রবর্তী-বংশ কুলীন। সেকালে শ্রোত্রিয়গণ কন্যা সম্প্রদান করিতেন কুলীনের হাতে। রামেশ্বরের পিতামহ পরমেশ্বর রায়-বংশের মাঝের বাড়ির সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণী কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন। বিবাহ করিয়াও তিনি শ্বশুর বর্তমানে কখনও স্থায়ীভাবে শ্বশুরালয়ে বাস করেন নাই। শ্বশুরের মৃত্যুর পর তিনি যেদিন এখানে আসিয়া মালিক হইয়া বসিলেন, রায়েদের সহিত তাহার বিবাদও বাধিল সেই দিনই। সেদিনও রায়েদের মুখপাত্র ছিলেন ওই ছোট বাড়িরই কর্তা– এই ইন্দ্র রায়ের পিতামহ রাজচন্দ্র রায়। সেদিন পরমেশ্বর চক্রবর্তীর শ্বশুরের অর্থাৎ রায়-বংশের মাঝের বাড়ির কর্তার শ্রাদ্ধবাসর। রাজচন্দ্র রায়ের উপরেই শ্রাদ্ধের সকল বন্দোবস্তের ভার ন্যস্ত ছিল। মজলিসে বসিয়া রাজচন্দ্র গড়গড়ার নল টানিয়া পরমেশ্বর চক্রবর্তীর হাতে তুলিয়া দিলেন। পরমেশ্বর নলটি না টানিয়াই রায়-বংশধরের হাতে সমর্পণ করিলেন। তার পর নিজের ঝুলি হইতে ছোট একটি হুঁকো ও কল্কে বাহির করিয়া একজন চাকরকে বলিলেন, কোন ব্রাহ্মণকে দে, জল সেজে এই কল্কেতে আগুন দিয়ে দিক। তিনি ছিলেন পরম তেজস্বী তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ।