উৎসাহিত হইয়া প্রজারা বলিল, আজ্ঞে, ওই লদীর উ-পারের চরটার কথা বলছি। ই-পারে আমাদের জমি খেয়ে তবে তো লদী উ-পারে উগরেছে; আমাদের জমি যে পয়োস্তি হল– তার খাজনা তো আমরা কমি পাই নাই, আমরা তো বছর বছর লোকসান গুনে যাচ্ছি।
বাঁ হাতে গোঁফে তা দিতে দিতে রায় বলিলেন, বেশ তো, লোকসান দিয়ে দরকার কি তোদের? লোকসানী জমা ইস্তফা দিলেই পারিস। বাঁ হাতে গোঁফে তা দেওয়া রায়ের একটা অভ্যাস। লোক বলে, ওই সঙ্গে তিনি মনে মনে বুদ্ধিতে পাক মারেন।
প্রজারা হতভম্বের মত রায়ের মুখের দিকে খানিকক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল, আজ্ঞে, ই তা হলে বিচার কি করলেন আপনি?
হাসিয়া ইন্দ্র রায় বলিলেন, তোরা যা বলবি, তাতে সায় দেওয়ার নামই তো বিচার নয় রে! বিচারের তো একটা আইন আছে, সেই আইনমতেই তো জজকে রায় দিতে হয়।
প্রজারা হতাশ হইয়া উঠিয়া চলিয়া গেল। যাইবার পথে তাহারা পরামর্শ করিয়া উঠিল গিয়া রামেশ্বরবাবুর বাড়ি। কাছারিতে মালিক কেহ নাই, চাকরটা বলিল, বড়বাবুও নাই, নায়েববাবুও নাই, কর্তাবাবুর সঙ্গে তো দেখা হবেই না।
প্রজারা গ্রামেরই লোক, তাহারা সকল সংবাদই রাখে, তাহারা জানে, এখন এ বাড়ির সব কর্মের অন্তরালে একটি দৃশ্য শক্তি কাজ করে, পরমাশক্তির মত তিনিও নারীরূপিণী। তাহারা বলিল, আমরা মায়ের সঙ্গে দেখা করব।
চাকরটা অবাক হইয়া গেল, এমন ধারার কথা সে কখনও শোনে নাই। সে বলিল, তোমরা কি ক্ষেপেছ নাকি?
রামেশ্বরবাবুর ছোট ছেলে অহীন্দ্র পাশেই একখানা ঘরে পড়িতেছিল, সে এবার বাহির হইয়া আসিল। খাপখোলা তলোয়ারের মত রূপ–ঈষৎ দীর্ঘ পাতলা দেহ, উগ্রগৌর দেহবর্ণ, পিঙ্গল চোখ, মাথার চুল পর্যন্ত পিঙ্গলাভ। তাহাকে দেখিয়া প্রজারা উৎসাহিত হইয়া উঠিল। এ-বাড়ির বড় ছেলে মহীন্দ্রকে দেখিয়া তাহাদের ভয় হয়, দশটা কথার পর মহীন্দ্র একটা জবাব দেয়, তাহাদের মুখের দিকে চাহিয়া পর্যন্ত সে কখনও কথা বলে না। আর এই ছোটদাদা বাবুটির রূপ যতই উগ্র হউক না কেন, এমন নিঃসঙ্কোচ স্বচ্ছন্দ ব্যবহার, এমন মধুমাখা মিষ্ট কথা তাহারা কাহারও কাছে পায় না। গল্প লইয়া তাহাদের সহিত তাহার মিলনক্ষেত্র গড়িয়া উঠিয়াছে। প্রাচীন চাষীদের কাছে সাঁওতাল বিদ্রোহের গল্প শুনিতে যায়, সে নিজে বলে দেশবিদেশের কত গল্প। সমুদ্রের ধারে সোমনাথ শিবমন্দির লুঠের কথা, আমেরিকার সাহেবদের সঙ্গে বিলেতের সাহেবদের লড়াইয়ের কথা। তাহারা বিস্ময়বিমুগ্ধ হইয়া শোনে। অহীন্দ্রকে দেখিয়া তাহারা পরম উৎসাহের সহিত বলিল, ছোটদাদাবাবু কবে এলেন?
অহীন্দ্র এখান হইতে দশ মাইল দূরে শহরের স্কুলে পড়ে। অহীন্দ্র হাসিয়া বলিল, কাল সন্ধ্যাবেলা এসেছি, চারদিন ছুটি আছে। তারপর, তোমরা এসেছ কোথায়? দাদাও বাড়ি নেই, নায়েব-কাকাও নেই।
তাহারা বলিল, আপনি তো আছেন দাদাবাবু, আপনি আমাদের বিচার করে দ্যান।
খিলখিল করিয়া হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, আমি বিচার করতে পারি নাকি, দূর দূর!
তাহারা ধরিয়া বসিল, না দাদাবাবু, আপনাকে আমাদের এ দুঃখের কথা শুনতেই হবে। না শুনলে আমরা দাঁড়াব কার কাছে? নইলে নিয়ে চলুন আমাদের মায়ের দরবারে। আমরা না খেয়ে পড়ে থাকব এইখানে।
অহীন্দ্র মায়ের কাছে গেল। সুনীতি স্বামীর জন্য আহার প্রস্তুত করিতেছিলেন। অহীন্দ্র আসিয়া দাঁড়াইতে বলিলেন, কি রে অহি?
মা ও ছেলের এক রূপ, তফাৎ শুধু চুল ও চোখের। মুখ, রং ও দেহের গঠনে অহি যেন মায়ের প্রতিবিম্ব–কেবল পিঙ্গল চুল ও চোখ তাহার পিতৃবংশের বৈশিষ্ট্য। সুনীতির বড় বড় কালো চোখ, চুলও ঘন কৃষ্ণবর্ণ। তাহার বড় ছেলে মহীর সহিত তাহার কোন সাদৃশ্যই নাই, সর্ব অবয়বে সে তাহার পিতার অনুরূপ।
অহি সকল কষা মাকে বলিয়া বলিল, ওরা একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে মা। কি বলব ওদের? ছেলের মুখের দিকে চাহিয়া মা ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, সে কখনও হয় অহি? আমি কেন দেখা করব ওদের সঙ্গে? তুই একথা বলতে এলি কি বলে?
অহি সঙ্গে সঙ্গে ফিরিল। মা হাসিয়া পিছন হইতে ডাকিয়া বলিলেন, অমনি চললি যে?
অহি পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, বলি গে ওদের সেই কথা।
কই, একবার মুখখানা দেখি।
ছেলে ফিরিয়া দাঁড়াইল, মা তাহার চিবুকখানা স্পর্শ কৱিয়া বলিলেন, এমন ফুলটুস ছেলে আমি কোথাও দেখি নি। একেবারে ফুলের ঘায়েও রাগ হয়ে যায়।
সত্য কথা, মায়ের সামান্য কথাতেই অহির অভিমান হইয়া যায়। এ সংসারে তাহার সকল আবদার একমাত্র মায়ের উপর। শৈশব হইতেই সে বাপের কাছে বড় ঘেঁষে না, তাহার বড় ভাই মহীন্দ্র বরং পিতার কাছে কাছে ফিরিয়া থাকে। দুই ভাই প্রকৃতিতে যেন বিপরীত। মহীন্দ্র অভিমান জানে না, সে জানে দুর্দান্ত ক্রোধে আত্মহারা হইয়া আঘাত করিতে, শক্তিবলে আপনার ঈপ্সিত বস্তু মানুষের কাছ হইতে আদায় করিয়া লইতে। ইস্পাতের মত সে ভাঙিয়া পড়ে, তবু কোনমতেই নত হয় না। আর অহি খাঁটি সোনার মত নমনীয়–আঘাতে ভাঙে না অভিমানে বাঁকিয়া যায়।
মা আবার প্রশ্ন করিলেন, রাগ হল তো অমনি?
না।
কেন? আমি যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তুই বুঝি ওদের বলেছিস, মায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিবি?
অহি বলিল, বলি নি, কিন্তু দেখা করতে ক্ষতি কি?