হয়েছিল; ভাল হয়ে গেল। মহীন আর অহীন ভাল করে দিলে। একটি হাত ও চোখ দেখাইয়া বলিলেন, এইটে অহীন, আর এইটে মহীন। তারপর মৃদুস্বরে বলিলেন তোমার গর্ভের দোষ নয়, আমার রক্তের দোষ। জান সুনীতি আমাদের বংশ পাপের বংশ। নবাবরা দেওয়ালে পুঁতে মানুষ মারত। আমার কিন্তু সব পাপ নষ্ট হয়ে গেল। সব রোগ ভাল হয়ে গেল।
সুনীতি নীরবে বসিয়া রহিলেন, সূতা কাটা ঘুড়ির মত তাহার মন জীবনকেন্দ্র হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছে, তাহাকে আকর্ষন করিতে আর কিছুতেই পারিতেছে না। বিহ্বল দিশাহারার মত উদাস তিনি।
কিছুক্ষণ পরেই বাহিরে পাখীরা কলরব করিয়া প্রত্যুষ ঘোষণা করিয়া দিল। রামেশ্বর চকিত হইয়া বলিলেন, ভোর হয়ে গেল? বলিতে বলিতে বিছানা হইতে নামিয়া তিনি জানলা খুলিয়া দিলেন। আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া তিনি দাঁড়াইলেন, সম্মুখে আকাশে মুক্তির বার্তা বহন করিয়া উদয়াচল হইতে মৃত্তিকার বুকে লক্ষ লক্ষ যোজনা অতিক্রম করিয়া ধারায় ধারায় আলোকের বন্যা ছুটিয়া আসিতেছে। মুহূর্তে মুহূর্তে চারিদিক পরিষ্কার হইয়া উঠিতেছে সমস্ত দেখা যাইতেছে-জীর্ণ রায়হাট, শীতের শীর্ণা কালিন্দী, ও পারের চর আকাশে উদ্যত চিমনী কলের সারি সারি অট্টালিকা প্রশস্ত সুগঠিত পথ, লোকজন ঐশ্বর্যময়ী চর।
চরটা চোখে পড়িতেই সুনীতি চমকিয়া উঠিলেন। সর্বনাশা চর। ব্যাকুলভাবে তিনি প্রশ্ন করিলেন, তুমি কি-তুমি কি আমার সতীনের দেহ ওই-ওই ওই চরে পুঁতেছিলে?
সবিস্ময়ে মুখ ফিরাইয়া রামেশ্বর বলিলেন না বাড়িতে কুয়ার মধ্যে। সেটা বন্ধ করে দিয়েছি।
সুনীতি বিহ্বল বিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন তবে? দিশাহারা বিহ্বল মন উদ্ভট চিন্তা, উদ্ভট প্রশ্ন জাগিয়া উঠিতেছিল। সতীনের কঙ্কালের উপর তো চরটা গড়িয়া উঠে নাই তবে কেন এমন হল?
রামেশ্বর সে কথায় কান দিলেন না, মুখ ফিরাইয়া আপনার দুইটা হাত শূন্যালোকে প্রসারিত করিয়া দিলেন। তখন দিগন্তশিখরে সূর্য দেখা দিয়াছে, অতিরিক্ত আলোক অকৃপন দীপ্তি ও উত্তাপ লইয়া রামেশ্বরের। হাতের উপর ছড়াইয়া পড়িল। হাতের দিকে চাহিয়া রামেশ্বর বলিলেন, আঃ, কোন দাগ নেই একেবারে সাদা হয়ে গেছে।
অস্থিচর্মসার রক্তহীন বিবর্ণ দুখানি হাত।
হাত দুইখানি মুক্ত করিয়া রামেশ্বর সূর্যকে প্রণাম করিলেন জবাকুসুম-সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং। ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।
সুনীতি উদাস দৃষ্টিতে চরটার দিকে চাহিয়া ছিলেন, রামেশ্বর কথা কানে যাইতেই তিনি আকাশের দিকে চাহিলেন; সম্মুখেই রক্তিম সূর্য উদয়শিখর হইতে অস্তাচল পর্যন্ত মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ সর্ব পাপঘ্ন দেবতার মহাদ্যুতিতে ঝলমল করিতেছে। তাহারই প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে রায়হাটে কালিন্দীর চরে সর্বত্র সর্বত্র।
ওই দূরে নতুন ওঠা সর্বনাশা চরটার কোল ঘেঁষিয়া শীর্ণা কালিন্দীর বারোমেসে অগভীর অপরিসর জলধারা বহিয়া চলিয়াছে। মন্থর তাহার গতি এখন। কালের ভগ্নী কালিন্দী! কালিন্দীর জলস্রোতের মধ্যে নূতন চরটার ছায়া প্রতিফলিত হইয়াছে। গাছ-গাছালির মধ্যে চিনির কলের চিমনিটা স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। চিমনিটার গায়ে প্রভাতসূর্যের রৌদ্র পড়িয়াছে-তাহাও ফুটিয়াছে প্রতিবিম্বের মধ্যে।
নিত্য প্রভাতে উঠিয়াই প্রথম এই চরটার ছবি ওই কালিন্দীর জলে দেখিয়া আসিতেছেন। চরটা যেন তাহার ভাগ্য তাহার ঘর সংসারকে বেষ্টন করিয়া পাক দিয়া পাকে পাকে জড়াইয়াছে বলিয়া তাহার মনে হইত। আজ মনে হইল কালের ভগ্নী কালিন্দী মহাকালের নির্দেশকে প্রতিফলিত করিয়া চলিতেছে। আগে যেখানে কালিন্দীর জলে শুধু আকাশ ও নদীতীরের গাছ গাছালি তৃণবনের ছায়া ভাসিত আকাশে ওড়া বকের সারির ছবি ভাসিত–আজ সেখানে কালিন্দীর সেই স্রোতধারায় উদয় সূর্যের আলোয় আলোকিত কলের চিমনি এবং চিমনিতে ওঠা ধোঁয়ার রাশি একটা অনির্দেশ্য শাসনের মত ভাসিতেছে বলিয়া মনে হইল। আরও ভবিষ্যত কালে এই চরের ভাঙা গড়ার সঙ্গে আরও কত ছায়া আরও কত নবতর মূর্তি ওই স্রোতে ফুটিয়া উঠিবে মানুষকে ভয় দেখাইবেন কে জানে। কিন্তু তাহার আর ভয় নাই। না। বরঞ্চ চরাচরব্যাপী আলোর মধ্যে যে আশ্চর্য অভয় আছে তাহারই স্পর্শ পাইয়া সুনীতি আশ্বস্ত হইলেন। তাহার চোখ ফাটিয়া জল আসিল।