পুলিস অহীন্দ্রকে লইয়া চলিয়া গেল। হেমাঙ্গিনী আছাড় খাইয়া পরিলেন, উমা নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল, চোখভরা জল আঁচলে মুছিয়া সে মাকে ডাকিল, ওঠ মা। একদিন তো তিনি ফিরে আসবেন; কেঁদো না। হেমাঙ্গিনী মুখ তুলিয়া মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া অবাক হইয়া গেলেন।
ইন্দ্র রায় মাথা নীচু করিয়া পায়চারি করিতেছেন। রায়-বাড়ি ও চক্রবর্তী-বাড়ির মিলিত জীবন-পথ আবার ভাঙিয়া গেল। পরমুহর্তে মনে হইল, না না, ভাঙে নাই। বিপদ আসিয়াছে আঘাত আসিয়াছে সে আঘাত দুই বাড়িকেই সমানভাবে বেদনা দিয়াছে; কিন্তু বিচ্ছেদ হয় নাই, দুই বাড়ির বন্ধন ছিন্ন হয় নাই। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া তিনি ডাকিলেন ইষ্টদেবীকে, তারা, তারা মা! তারপর বলিলেন, ওঠ গিন্নী, ওঠ।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, ওগো আর নয়, তুমি কাশী যাবে বলছিলে, কাশী চল।
যাব। অহীন্দ্রের বিচার শেষ হোক। মা যে বাধা দিলেন। উমা, তোর শাশুড়ী কোথায় গেলেন, দেখ মা।
রামেশ্বরের ঘরে সুনীতি মাটির উপর মুখ খুঁজিয়া মাটির প্রতিমার মতই পড়িয়াছিলেন, মৃদু নিঃশ্বাসের স্পন্দন ছাড়া একটুকু আক্ষেপ সর্বাঙ্গের মধ্যে কোথাও ছিল না; মহী যেদিন আত্মসমর্পণ করে সেদিনও ঠিক এমনিভাবেই তিনি পড়িয়া ছিলেন।
খাটের উপর রামেশ্বর বসিয়া ছিলেন পাথরের মত।
.
৩৫.
গভীর রাত্রি।
রামেশ্বর তেমনি পাথরের মূর্তির মত বসিয়া আছেন। তেমনি দৃষ্টি তেমনি ভঙ্গি। ঘরের মধ্যে তেমনি। স্বল্প আলোক, আলোক-পরিধির চারিপাশ তেমনি নিথর অন্ধকার। সুনীতি তেমনি উপুড় হইয়া মাটিতে মুখ খুঁজিয়া পড়িয়া আছেন। উমাকে হেমাঙ্গিনী লইয়া গিয়াছেন। রায় লইয়া যাইতে চান নাই। কিন্তু হেমাঙ্গিনীর কাতরতা দেখিয়া না বলিতেও পারেন নাই। অপরাধীর মত বলিয়াছিলেন, কাল সকালেই পাঠিয়ে দেব উমাকে।
একবার মাত্র মুখ তুলিয়া সুনীতি বলিয়াছেন বেশ।
মানদা নীচে পড়িয়া কাঁদিতেছে।
শোকাচ্ছন্ন নীরবতা ভঙ্গ করিয়া রামেশ্বর বলিলেন, জল। শুষ্ক কণ্ঠস্বর দিয়া রব বাহির হিল না, কিন্তু ভাষা বোঝা গেল।
সুনীতি একটা দীর্ঘনিঃসশ্বাস ফেলিয়া উঠিলেন, মনে তাহার অনুতাপ হইল, আজ রামেশ্বরের খাওয়া পর্যন্ত হয় নাই। উঠিয়া তিনি দেখিলেন, উমা জলখাবার সাজাইয়া কোণের টেবিলের উপর নিয়মমত রাখিয়া গিয়াছে। জলখাবারের থালা ও গ্লাসটি আনিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, খাও কিছু। আমি ভুলে গেছি, মনে করতে পারি নি।
জলের গ্লাসটি শুধু তুলিয়া লইয়া নিঃশেষে পান করিয়া রামেশ্বর খাদ্য প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিলেন, না।
সুনীতি এতক্ষণে ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন।
রামেশ্বর মৃদুস্বরে প্রশ্ন করিলেন, অহীনের কি ফাঁসী হবে?
আর্তস্বরে সুনীতি বলিয়া উঠিলেন, না না, সে তো খুন করে নি, বিপ্লবের খুনের ষড়যন্ত্র করেছিল, খুন তো করে নি।
রামেশ্বর বলিলেন, তোমার পূণ্য, উমার ভাগ্য তাকে বাঁচিয়েছে।
সুনীতি চুপ করিয়া রহিলেন।
রামেশ্বর বলিলেন, আচ্ছা, ওরা আমাকে কেন সাজা দিক না। অহীন তো আমারই ছেলে। দোষ তো আমারই।
আবেগপীড়িত কণ্ঠে সুনীতি বলিলেন, না না, আমার জন্যেই তোমার এত কষ্ট। তোমার দোষ নয়, আমার ভাগ্যের দোষ, আমার গর্ভের দোষ।
অতি ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া বলিলেন না।
তারপর বহুক্ষণ নীরবতার পর বলিলেন, জান না তুমি, কেউ জানে না। আমারই রক্তের দোষ। ছায়ামূর্তির মত মৃদু সঞ্চালনে হাত তুলিয়া অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া বলিলেন, ওইখানে তোমার দিদিকে রাধারাণিকে আর আমার প্রথম সন্তানকে গলা টিপে মেরেছিলাম।
সুনীতি আতঙ্কে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
রামেশ্বর বলিতেছিলেন, একদিন দেখলাম, রায় বাড়িতে রাধারাণী সুন্দর একটা ছেলের সঙ্গে হাসছে। সে তার পিসতুতো ভাই। আমার চরিত্র-দোষ ছিল কিনা, আমার সন্দেহ হল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন, সংসারে এই নিয়ম, ‘আত্মবৎ মন্যতে জগৎ’। যে অন্ধ সে পৃথিবীকে অন্ধকার দেখে, এ প্রকৃতির নিয়ম। রামেশ্বর নীরব হইলেন।
কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, ছেলেটা হল, তার চুল কালো হল, আমাদের মত পিঙ্গল হল না। আমি যেন পাগল হয়ে গেলাম। ঠিক মনে হল, ছেলেটা তার মত দেখতে। একদিন শুয়ে ছিল ছেলেটা, গলা টিপে দিলাম।
সুনীতি থরথর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে স্বামীর মুখ চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, না না না বলো না, বলো না।
রামেশ্বর নীরব হইয়া বসিয়া রহিলেন। বহুক্ষণ পর আবার অকস্মাৎ বলিলেন, কিন্তু রাধারানি বুঝতে পেরেছিল। হয়ত দেখেছিল। কিন্তু সে কাঁদলে না। শুধু বললে, যে চোখে তুমি এমন কূ দেখলে ওই চোখ তোমার অন্ধ হয়ে যাবে।
আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া বলিলেন, সে কাউকে কিছু বললে না, বাপের বাড়িও গেল না; একদিন কাশী যাবে বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। সন্ধ্যাবেলা একাই চলে গেল। আমি সেই রাত্রেই স্টেশন থেকে ফিরিয়ে এনে, ওইখানে গলা টিপে–। যখন তার গলা টিপে ধরলাম, সে অভিশাপ দিল, চোখ নয়, ওই দুই হাতেও তোমার কুষ্ঠ হবে।
সুনীতির যে সব গোলমাল হইয়া যাইতেছে। স্থান কাল পাত্র সব ঝাপসা হইয়া গিয়াছে। বিহ্বল দৃষ্টিতে তিনি স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া ছিলেন, নির্বোধের মত তিনি এবার বলিলেন, কই, তোমার তো কুষ্ঠ হল না? তোমার চোখ তো অন্ধ হয় নি?