কে? কে?-শঙ্কিত ব্যাগ্রকণ্ঠে সুনীতি প্রশ্ন করিলেন।
মা!
অহীন?…যাই যাই, দাঁড়া।
মাথার টুপিটা খুলিয়া ফেলিয়া রেন কোর্টের বোতাম খুলিতে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া অহীন্দ্র মৃদু হাসিল, ছলনা করিয়া মাকে ভুলাইবার জন্যই সে হাসিল।
সুনীতি অপলক চক্ষে অহীন্দ্রের দিকে চাহিয়া ছিলেন; চোখে জল ছিল না, কিন্তু ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল, অহীন্দ্রের হাসি দেখিয়া তাঁহার কম্পিত অধরেও একটি অস্পষ্ট বিচিত্র হাস্য রেখা ফুটিয়া উঠিল, মৃদুস্বরে বলিলেন, আমি সব শুনেছি অহীন।
অহীন্দ্র চমকিয়া উঠিল।
সুনীতি বলিলেন, বউমা আমাকে সব বলেছে।
ও-বাড়ির ওঁরা? তা হলে কি তোমরাই-? তাহার সন্দেহ হইল, হয়তো প্রাচীন জমিদারবংশ তাহাকে রক্ষার্থে রাজভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া পুলিসের শরণাপন্ন হইয়াছেন।
না, আর কেউ জানে না। আমাকে না বলে বউমা বাঁচবে কি করে বল? এত দুঃখ সে কি লুকিয়ে রাখতে পারে? কিন্তু এ তুই কি করলি বাবা?
কোটের শেষ বোতামটা খুলিয়া অহীন্দ্র মৃদু হাসিয়া বলিল, আজই রাত্রে আমাকে চলে যেতে হবে মা, পুলিস আমদের দলের সন্ধান পেয়ে গেছে।
সুনীতি সমস্ত শুনিয়াছেন জানিয়া সে আর ভূমিকা করিল না, সান্তনা দিবার চেষ্টা করিল না। একেবারে কঠিনতম দুঃসংবাদটা শুনাইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইল। একবার শুধু হাস্যমুখে মুখ ফিরাইয়া উমার দিকে চাহিল। খাটের বাজু ধরিয়া উমা দাঁড়াইয়া আছে। সে তাহাকে বলিল, একটু চা খাওয়াও দেখি উমা। সঙ্গে কিছু খাবার-খিদে পেয়ে গেছে।
***
সুনীতি শুধু বলিলেন, তুই যদি বিয়ে না করতিস অহীন, আমার কোন আক্ষেপ থাকত না। অহীন্দ্র উত্তরে উমার দিকে চাহিল, উমার মুখে বেদনার্ত ম্লান হাসি; কিন্তু কোন অভিযোগ সেখানে ছিল না, তাহার জলভরা চোখে স্বচ্ছ জলতলে বাড়বহ্নিদীপ্তির মত তরুণ প্রাণের আত্মত্যাগের বাসনা জ্বলজ্বল করিতেছে। অহীন্দ্র মাকে বলিল, উমা কোনদিন সে-কথা বলবে না মা; উমা এ-যুগের মেয়ে।
সুনীতি একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন, তারপর বলিলেন, একটু বিশ্রাম করে নে বাবা, আমি ঠিক ভোরবেলা তোকে জাগিয়ে দেব। তিনি উঠিয়া গেলেন; বধুকে বলিলেন, দরজা বন্ধ করে দাও বউমা।
উমা দরজা বন্ধ করিয়া অহীন্দ্রের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; অহীন্দ্র তাহার মুখের দিকে চাহিয়া মৃদু হাসিল, কিন্তু কোন কথা বলিতে পারিল না। তাহার ভয় হইতেছিল এখনই হয়তো উমা ভাঙিয়া পড়িবে।
কথা বলিল উমা নিজে। বলিল শুয়ে পড় এখন ঘুমিয়ে নাও।
অহীন্দ্র একান্ত অনুগতের মতই শুইয়া পড়িল। উমা তাহার মাথার চুলের মধ্যে আঙুল চালাইয়া যেন তাহাকে ঘুম পাড়াইতে বসিল।
ভোরবেলা, খানিকটা রাত্রি ছিল তখনও। সুনীতি আসিয়া ডাকিলেন, বউমা! বউমা!
উমা কখন ঘুমে ঢলিয়া অহীন্দ্রের পাশেই শুইয়া ঘুমাইয়া গিয়াছিল, কিন্তু ঘুমের মধ্যেও তাহার উদ্বেগকাতর মন জাগিয়া ছিল, দুই বার ডাকিতেই তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল; তাড়াতাড়ি উঠিয়া সে অহীন্দ্রকে ডাকিয়া তুলিল। অহীন্দ্র উঠিয়া জানলা খুলিয়া একবার বাহিরটা দেখিয়া লইল, তারপর একবার গভীর আবেগে উমাকে বুকে টানিয়া লইয়া তাহার কম্পিত অধরে প্রগাঢ় একটি চুম্বন করিল; কিন্তু সে ওই মুহর্তের জন্য, সে জামা পরিয়া জুতার ফিতা বাঁধিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িল। উমা দরজা খুলিয়া দিল, সুনীতি আসিয়া ঘরে। প্রবেশ করিলেন। অহীন্দ্র আর কাহারও মুখের দিকে চাহিল না, হেঁট হইয়া মায়ের পায়ে একটি প্রণাম করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িল। সিঁড়ি অতিক্রম করিয়া দরজা খুলিয়া সে রাস্তায় বাহির হইয়া গেল, দরজার দাঁড়াইয়া সুনীতি ও উমা দেখিলেন, রাত্রিশেষের তরল অন্ধকারের মধ্যে অহীন্দ্র যেন কোথায় মিশিয়া গেল।
বেলা দশটা হইতেই কিন্তু অহীন্দ্র আবার ফিরিয়া আসিল, তাহার সঙ্গে পুলিস। রেলস্টেশনে পুলিস তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছে। ইউ.পি হইতে পুলিস জেলা পুলিসকে টেলিগ্রাম করিয়া ছিল। পুলিস এখন বাড়ি ঘর খানা তল্লাস করিয়া দেখিবে।
অভিযোগ গুরুতর-রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং রাজকর্মচারী হত্যার ষড়যন্ত্র।
***
দশটা হইতে আরম্ভ করিয়া বেলা তিনটা পর্যন্ত খানাতল্লাসি করিয়া পুলিসের কাজ শেষ হইল। ইন্দ্র রায়ের বাড়িও খানাতল্লাস হইয়া গেল। বাড়ির আশেপাশে লোকে লোকারণ্য হইয়া উঠিয়াছিল। কাহারও চোখই শুষ্ক ছিল না, হ্যাণ্ডকাপ দিয়া কোমরে দড়ি বাঁধিয়া অহীন্দ্রকে লইয়া যাইতে দেখিয়া সকলেরই চোখ সজল হইয়া উঠিল। তাহার মধ্যে অঝেরঝরে কাঁদিতেছিল কয়েকজন; মানদা, মতি বাগদিনী প্রিয়জন বিয়োগের শোকার্তের মতই কাঁদিতে ছিল। আর কাঁদিতেছিলেন যোগেশ মজুমদার। লজ্জা আর অনুতাপে তাহার আর সীমা ছিল না। সমস্ত কিছুর জন্য সে অকারণে আপনাকে দায়ী করিয়া অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল। এ-কান্না তাহার সাময়িক, হয়তো কালই সে কলের মালিকের ইঙ্গিতে চক্রবর্তী-বাড়ির অনিষ্ট সাধনে উঠিয়া পড়িয়া লাগিবে, কিন্তু তবু সে আজ কাঁদিতেছিল। অচিন্ত্যবাবুও একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া বেশ স্কুটভাবেই ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতেছিলেন, এই মর্মন্তুদ দৃশ্য দুর্বল মানুষটি কোনমতেই সহ্য করিতে পারিতেছেন না। রংলালও কাঁদিতেছে। কেবল একটি মানুষ ক্রোধভরে আস্ফালন করিতেছিল, হু হু বাবা, এয়ারকি, গবরমেন্টারের সঙ্গে চালাকি! সে শূলপাণি, সদ্য গাঁজা টানিয়া সে জ্ঞাতিশত্রু-নিপাতের তৃপ্তিতে আস্ফালন মুখর হইয়া উঠিয়াছে।