উমা নীরবে নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।
অহীন কেন এমন হল? আমার মন যেন কেমন হাঁপিয়ে উঠেছে।
আজ সমস্ত দিনটা উমার মনও বিচলিত হইয়া ছিল, সে আর থাকিতে পারিল না। কাঁদিয়া ফেলিল, অন্ধকারের মধ্যে কম্পনত্রস্ত দেহ দেখিয়া উমার কান্না সুনীতি অনুমান করিলেন, বধুর মুখে হাত দিয়া তিনি চমকাইয়া উঠিলেন, বলিলেন, কাঁদছ কেন বউমা? কি হয়েছে মা? আমাকে বলবে না?
উমা আর গোপন করিতে পারিল না; নূতন যুগের মেয়ে সে, আধুনিক শিক্ষাদিক্ষার সহিত পরিচয়ের ফলে অহীন্দ্রের যে-কথা সে স্বীকার করিয়া লইয়াছে, কঠিন উদ্বেগ আশঙ্কা সহ্য করিয়াও এতদিন গোপন রাখিয়াছিল, আজিকার এই বিচলিত চরম মূহর্তটিতে অহীন্দ্রের মায়ের কাছে তাহা প্রকাশ করিয়া ফেলিল। সবটা সে জানিত না, যতটুকু জানিত ধীরে ধীরে ততটুকুই বলিল।
সুনীতির সর্বাঙ্গ থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল, সমস্ত ব্যাপারটা না বুঝিলেও তাহা যে ভয়ঙ্কর কিছু ইহা অনুভব করিলেন; ব্যাকুল আশঙ্কায় অধীর হইয়া তিনি প্রশ্ন করিলেন, এরা কি চায় মা?
ঠিক তো জানি না মা। তবে মনে হয়, এরা চায়, মানুষের সঙ্গে মানুষের কোন ভেদ থাকবে না; জমি ধন সব সামানভবে ভাগ করে নেবে। সেইজন্য তারা বিপ্লব করে এ-রাজত্ব উলটে দিতে চায়। সে আবার কাঁদিয়া ফেলিল।
সুনীতির মনে পড়িল, অহীন্দ্র তাহাকে ইঙ্গিতে বলিয়াছিল, তিনি তাহা বুঝিতে পারেন নাই। তিনি স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পর উমা বলিল- সে আজ আর কথাগুলি গোপন করিয়া রাখিতে পারিতেছে না বলিল, সাঁওতালদের চরের জমি কেড়ে নেওয়ার পর তারা একদিন ভোর-রাত্রে চর থেকে উঠে চলে গেল; তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলেন। সেদিন আমায় বলেছিলেন, এ-পাপ আমাদের পাপ। পুরুষ পুরুষ ধরে এই পাপ আমাদের জমা হয়ে আসছে, কলের মালিক একা এর জন্য দায়ী নয়। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমাকে করতে। হবে। আমি সেদিন বুঝতে পারি নি মা। আবার পুজোর সময় আমি বুঝতে পারলাম; সুটকেস খুলে কাপড় গোছতে গিয়ে, কখানা চিঠি থেকে বুঝতে পারলাম। আর সে বলিতে পারিল না, অনর্গল ধারায় চোখের জল তাহার মুখ ভাসাইয়া ঝরিতে আরম্ভ করিল।
অনেকক্ষণ পর সুনীতি বলিলেন, চল, বউমা, দাদার কাছে যাই। তিনি ভিন্ন আর কে উপায় করবেন?
উমা অতিমাত্রায় ব্যাগ্র হইয়া কাতরভাবে বলিয়া উঠিল না, না। তাতে তাঁকে বিশ্বাসঘাতক হতে হবে, সমস্ত দল ধরা পড়ে যাবে মা। না না।
সুনীতি পাথর হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। উমাও নীরব।
ও-পারের চরে বাজনার শব্দ উন্মত্ত উজ্জ্বলতায় উচ্চ হইয়া উঠিয়াছে। নদীর চরের উপর লাল আলোর মধ্যে সেই দীর্ঘাঙ্গী কালো মেয়েটা উন্মত্ত আনন্দে যেন তাণ্ডবনৃত্য করিতেছে। লম্বা ফালি সর্বনাশা চরটা যেন ঐ দীর্ঘাঙ্গী কালো মেয়েটার রূপ ধরিয়া সর্বনাশীর মত নাচিতেছে।
.
৩৪.
নিতান্ত বিস্মৃতিবশেই খান-দুই ইস্তাহার এবং একখানা পত্র সুটকেসের নীচে পাতা কাগজের তলায় রহিয়া গিয়াছিল; ঝাড়িয়া মুছিয়া গুছাইতে গিয়া উমা সেগুলি পাইয়াছিল। লাল অক্ষরে ছাপা ইস্তাহারখানা পড়িয়াই উমা ভয়ে উত্তেজনায় কাঁপিয়া উঠিয়াছিল, তারপর সেই পত্রখানা; তাহার মধ্যে সব সুস্পষ্ট- “মৃত্যু মাথায় করিয়া আমাদের এ অভিযান। প্রায় পৃথিবীব্যাপী বিরাট শক্তিগুলি ভরা রাইফেলের ব্যারেল উদ্যত করিয়া রাখিয়াছে। ফাঁসীর মঞ্চে দড়ির নেকটাই প্রস্তুত হইয়া ঝুলিতেছে। অন্যদিকে মানুষের আত্মঅজ্ঞাত স্বার্থবুদ্ধি প্রণোদিত বিধানের ফলে অসংখ্য কোটি মানুষের অপমৃত্যু যুগ যুগ ধরিয়া ঘটিয়া আসিতেছে” শেষের কয়টি লাইনের পাশে অহিন্দ্র দাগ দিয়া লিখিয়াছে, “আবছা অন্ধকারের মধ্যে সাঁওতালেরা চর ছাড়িয়া চলিয়া গেল। আমি চোখে দেখিয়াছি।”
উমা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে একে একে সমস্ত কথাই সুনীতিকে প্রকাশ করিয়া বলিল। বলিতে পারিল না কয়েকটি কথা; অহীন্দ্র ঠিক এই সময়েই আসিয়া পড়িয়াছিল, উমার হাতে কাগজ ও চিঠি দেখিয়া ছোঁ মারিয়া সেগুলি কাড়িয়া লইয়া বলিয়াছিল, এ তুমি কোথায় পেলে?
উমা যেমন ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া চিঠিখানা পড়িতেছিল, তেমন ভঙ্গিতেই দাঁড়াইয়া ছিল, ঠোঁট দুইটি কেবল থরথর করিয়া কাঁপিয়াছিল, উত্তর দিতে পারে নাই। অহীন্দ্র হাসিয়াছিল, হাসিয়া তাহাকে কাছে টানিয়া বলিয়াছিল, “না জাগিলে হায় ভারতললনা, ভারত স্বাধীন হল না হল না।” এই নব জাগরণের ক্ষণে তুমি টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির লেখাপড়া জানা মেয়ে কেঁদে ফেললে উমা? নাঃ, দেখছি তুমি নিতান্তই ‘বাঙালিনী’! তারপর সে তাহাকে বলিয়াছিল লেনিনের সহধর্মিণীর কথা, রাশিয়ার বিপ্লবের যুগের মেয়েদের কথা।
উমার তরুণ রক্তে আগুন ধরিয়া গিয়াছিল। স্বামীর সাধনমন্ত্র নিজের ইষ্টমন্ত্রের মত এতদিন সে গোপন করিয়া রাখিয়াছিল। কিন্তু আজ একটি বিচলিত মুহূর্তে স্বামীর বেদনা-বিচলিত মায়ের কাছে সে আত্মসংবরণ করিতে পারিল না, সব প্রকাশ করিয়া ফেলিল।
সুনীতি স্থির হইয়া শুনিলেন।
তিনি যেন পাথর হইয়া গেলেন। বজ্রগর্ভ মেঘের দিকে যে স্থির ভঙ্গিতে পাহাড়ের শৃঙ্গ চাহিয়া থাকে, সেই ভঙ্গিতে অপলক দৃষ্টিতে তিনি ভবিষ্যতের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
***
মাস দুয়েক পর একদিন সে বজ্ৰ নামিয়া আসিল।