আমার অনেক লজ্জা মা। জেদের বশে তোর শ্বশুরদের আমি অনেক অনিষ্ট করে দিলাম। সম্পত্তি তো শুধু অহীন্দ্রের নয়, মহীন্দ্রও ফিরে আসবে। লজ্জা আমার তার কাছেই হবে বেশি। আমার ইচ্ছে কি জানিস? আমার সম্পত্তির অর্ধেক আমি অহীন্দ্রকে উপলক্ষ করে ওদের দুজনকেই দিই। অহীন্দ্রের শ্বশুর হিসাবে নয়, সুনীতির ভাই সম্বন্ধ নিয়েই দিতে চাই।
উমা বলিল, বেশ তো, বিবেচনা করে যা হয় করবেন। কিন্তু কিছুদিন যাক, নইলে ওঁরা ভাববেন, আপনি ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন।
রায় হাসিয়া বলিলেন, কিছুদিন সময় আর আমার নেই মা। আমি আর সংসারে থাকব না, আমি কাশী যেতে চাই।
উমা মৃদুস্বরে বলিল, সংসারে হারজিত তো আছেই বাবা। তার জন্যে কাশী কেন যাবেন?
হেমাঙ্গিনী আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন, তার হাতে শরবতের গ্লাস। উমা আসিয়াছে- এই সুযোগে তিনি রায়কে শরবত খাওয়াইতে ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন।
রায় বলিলেন, আজ আহ্নিকে বসে জপ ভুলে গেলাম, মায়ের রূপ ধ্যান করতে পারলাম না। শুধু বললাম, চর চর, মামলা মামলা; আর ধ্যান করলাম, ওই রংলাল আর কলওয়ালার মুখ। আর নয়, আর সংসার নয় মা, আমি মন স্থির করে ফেলেছি, আমি কাশী যাব।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, বেশ তাই হবে। কিন্তু সে তো আর এখুনি নয়। এখন শরবতটা খাও দেখি।
***
চরের মামলায় পরাজয় হইয়াছে, চরটার সাথে সকল প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ শেষ হইয়া গিয়াছে- সংবাদটা শুনিয়া সুনীতি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। দুঃখের দীর্ঘনিঃশ্বাস। অথচ এই কামানা তিনি কিছুক্ষণ পূর্বেই শুধু নয়, চর লইয়া দ্বন্দ্ব আরম্ভ হইবার পর হইতেই অহরহ করিয়া আসিয়াছেন। বার বার তিনি মনে করিতে চেষ্টা করিলেন, ভালই হইয়াছে, ভাগ্যবিধাতা নিষ্ঠুর চক্রান্ত হইতে তাহাকে নিষ্কৃতি দিলেন। কিন্তু স্মৃতির মমতা তাঁহাকে তাহা ভাবিতে দিল না। তাঁহার মহীন্দ্র দ্বীপান্তরে গিয়াছে ওই চরের জন্য, তিনি নিজে প্রকাশ্য আদালতে দাঁড়াইয়াছেন ওই চরের জন্য। সংসারের চরম দুঃখের বিনিময়ে যাহা পাওয়া যায়, তাহার এক পরম মূল্য আছে।
আজ অহরহ তাঁহার মনে পড়িতে লাগিল মহীন্দ্রকে। দিনান্তে সন্ধ্যার সময় তিনি আসিয়া বারান্দায় বসিলেন। ও-পারের চরের উপর আজ বাজনা বাজিতেছে, আনন্দোন্মত্ত মানুষের কোলাহল ভাসিয়া আসিতেছে। হিন্দুস্থানি ঢোলক বাজিতেছে, আরও অনেক বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি শোনা যাইতেছে, কলের মালিক বোধ হয়। বিজয়োৎসব জুড়িয়া দিয়াছে। তিনি ছাদে গিয়া উঠিলেন, ছাদ হইতে চর, কালিন্দীর গর্ভ পরিষ্কার দেখা যায়। বাদ্যযন্ত্র ও কোলাহলের শব্দ স্পষ্ট হইয়া উঠিল।
অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিয়াছিল, দূরের চরের উপর আলো জ্বলিতেছে, আলোর ঘটা আজ অনেক বেশী। কালিন্দীর শুষ্ক গর্ভে বালির উপর একটা আলোর সমারোহ, মশালের আলোর মত দুই তিনটা আলো জ্বলিতেছে-রক্তাভ আলো! আলোর চারিপাশে ক্ষুদ্র একটা জনতার মধ্যস্থলে একটি দীর্ঘাঙ্গী কালো মেয়ে হাত ঘুরাইয়া, দেহ বাঁকাইয়া নানা ভঙ্গিতে নাচিতেছে।
মা!
সুনীতি চমকিয়া উঠিলেন, কে? পরক্ষণেই ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, বউমা!
উমাই ডাকিতেছিল, সে বলিল, এই আলোয়ানখানা গায়ে দিন মা, বড় কনকনে হাওয়া দিচ্ছে।
সত্য এইবার শীতটা বেশ তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিয়াছে। সুনীতি আলোয়ানখানি গায়ে দিয়া সস্নেহে বধুর দিকে চাহিয়া রহিলেন। উমা আজ মনে মনে লজ্জিত হইয়া ছিল, তাহার বাবা আজ সকালে যে বলিয়াছিলেন, আমি জেদের বশে অনেক ক্ষতি করে দিয়েছি, সেই কথাটা তাহার মনের মধ্যেও সংক্রামিত হইয়াছে। সে মাথা হেঁট করিল। অন্ধকারের মধ্যে সুনীতি উমার মুখ দেখিতে পাইলেন না বলিয়া কিছু বুঝিতেও পারিলেন না। সস্নেহেই তিনি প্রশ্ন করিলেন, আর কিছু বলছ বউমা?
না।–বলিয়া সে মন্থর পদক্ষেপে সিঁড়ির দরজা অতিক্রম করিয়া নীচে নামিয়া গেল। এপাশে সুনীতির সম্মুখে চক্রবর্তী-বাড়ির কাছারির প্রাঙ্গণে নারিকেল গাছগুলির মাথা, অন্ধকারের মধ্যে জটাজুটধারী তমোলোকবাসীদের মত শূন্যলোকে সভা করিয়া বসিয়া আছে। দীর্ঘ পাতাগুলির মধ্যে কি যেন গোপন কথার কানাকানি চলিতেছে। সুদীর্ঘ ঝাউগাছ দুইটা মর্মন্তুদ বেদানায় যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলিতেছে।
সুনীতির মনে পড়িয়া গেল অহীন্দ্রের কথা। বেশী দিন নয়, অল্পদিন পূর্বেই, এই ছাদে এমনি অন্ধকারে এমনি আবেষ্টনের মধ্যে অহীন্দ্র একা শুইয়া ছিল; তিনি আসিয়া তাহার কাছে বসিয়া কাতর-ভাবে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, কেন তুই দূরে চলে যাচ্ছিস, অহীন? আমরা যে তোর নাগাল পাচিচ্ছ নে বাবা?
তাঁহার আজিকার বিচলিত মন একেবারে অস্থির হইয়া উঠিল। অহীন্দ্র আজ পনেরো দিন পত্র দেয় নাই পুজোর ছুটির পর সেই গিয়াছে আর আসে নাই। যে-পত্র সে লেখে, সেও যেন কেমন-কেমন, মাত্র দুই তিন ছত্র। উমা চলিয়া গেল, তাহার মন্থর গতি এখন একটা অর্থ লইয়া তাহার মনের মধ্যে জাগিয়া উঠিল। উমা শুকাইয়া গিয়াছে। তাহাকেও কি সে এমনি ভাবে পত্র লেখে? সেও কি তাঁহারই মত তাহার নাগাল পায় না? দ্রুত ছাদের সিঁড়ির মুখে আসিয়া তিনি ডাকিলেন, বউমা বউমা! উমা!
মা!
উমা আবার আসিয়া তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইল।
অহীন তো তোমাকে পত্র দেয় নি বউমা!