সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল, সে আজ পনেরো দিনের উপর পত্র দেয় নাই। সে আজকাল কেমন যেন হইয়াছে!
***
প্রাতঃকাল হইতেই রায় গুম হইয়া বসিয়াছিলেন।
ভোর রাত্রে সদর হইতে মামলার সংবাদ লইয়া লোক ফিরিয়া আসিয়াছে। সমস্ত মামলাতেই জমিদার পক্ষ পরাজিত হইয়াছেন। চর লইয়া সমস্ত দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটিয়াছে। মাথা হেঁট করিয়া নিস্পন্দের মত তিনি বসিয়া রহিলেন। তাহার পরই সংবাদ আসিল, কলের মালিক মোটর লাঙল চালাইয়া চর দখল করিতেছে, এমন কি হালে বন্দোবস্ত করা চাষীদের জমিও দখল করিয়া লইতেছে। রায় সোজা হইয়া বসিলেন, আবার একটি সুযোগ মিলিয়াছে। চাষীদের সম্মুখে রাখিয়া আর একবার লড়িবেন তিনি। নায়েব মিত্তিরকে ডাকিয়া তিনি বলিলেন, জলদি বাগদীদের আর কাহারদের তলব দাও। আর চাষীদের ডাকাও দেখি।
সঙ্গে সঙ্গে লোক ছুটিল। রায় আবার গোঁফে পাক দিতে আরম্ভ করিলেন। চেয়ার ছাড়িয়া তিনি উঠিয়া পড়িলেন। সন্ধ্যার অন্ধকারের জন্য প্রতীক্ষামান গুহাচারী অস্থির বাঘের মত বারান্দায় পায়চারি আরম্ভ করিলেন। ঠিক এই সময়েই রংলাল আসিয়া তাহার পায়ের উপর উপুড় হইয়া পড়িল, ডাকিবার পূর্বেই সে নিজেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
রায় সস্নেহে বলিলেন, ও ও, ভয় নেই। আমি লাঠিয়াল দিচ্ছি, তোদের কিছু করতে হবে না, তোরা কেবল দাঁড়িয়ে থাকবি, দেখবি। টাকা পয়সা সমস্ত খরচ আমার, কোনও ভয় নেই তোদের।
রংলাল ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, আমরা যে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মেরেছি হুজুর!
রায় চমকিত হইয়া উঠিলেন, এই নির্বোধদের তিনি ভাল করিয়াই জানেন। ইহাদের সকলের চেয়ে বড় নির্বুদ্ধিতা এই যে, ইহারা নিজেদের ভাবে অতি বুদ্ধিমান-ভীষণ চতুর। বৈষয়িক জটিল বুদ্ধির প্রতি, কুটিল চাতুরির প্রতি এদের গভীর আসক্তি। সচকিত হইয়া রায় বলিলেন, কি করেছিস, সত্যি করে বল দেখি? সত্য কথা বলবি। ছাড় পা ছাড়-। তিনি আবার চেয়ার টানিয়া বসিলেন।
হাতের তালুর উলটা পিঠ দিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে রংলাল বলিল, আজ্ঞে হুজুর, ওই মজুমদারের ধায় পড়ে, উনিই বললেন, হুজুর
মজুমদার কি বললে?
বললে টাকার ভাবনা কি? আমি টাকা দেব।
কিসের টাকা?
আজ্ঞে, সেলামীর টাকা। আমাদের টাকা ছিল না হুজুর। উনিই আমাদিগে টাকা দিয়েছিলেন। আমাদের ‘বাপুতি’ সম্পত্তি বন্ধক নিয়ে দলিল করে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, চরের জমি বন্দোবস্ত হয়ে গেলে এ দলিল ফেরত দিয়ে চরের জমি বন্ধক দিয়ে দলিল করে নিতে হবে। এখন নতুন দলিলে সই করিয়ে নিয়ে বলছে হুজুর, বন্ধক নয়, জমি তোদের বিক্রি হয়ে গেল, এ দলিল কবলা-দলিল।
অজগরের মত একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া রায় বলিলেন, হুঁ।
হুজুর আমাদের কি হবে?
দলিল তোরা রেজেস্ত্রী করিস নে।
দলিল যে রেজেস্টারী হয়ে গেল হুজুর। নইলে যে সাবেক বন্ধকী দলিল ফেরত দিচ্ছিল না।
রংলাল আবার ফোঁসফোঁস করিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল।
রায় রুদ্ধমুখ আগ্নেয়গিরির মত বসিয়া রহিলেন। এই নির্বোধ অথচ কূটমতি অপদার্থগুলির উপর ক্রোধের তাঁহার সীমা রহিল না। তাঁহার জমিদার মন হতভাগ্যের নিরুপায় দিকটা দেখিতে পাইল না। হতভাগ্য অন্ধ বাঘের লেজে পা দিলে বাঘ তাহার অন্ধত্ব দেখিতে পায় না।
রংলাল তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল, রায়ের কোন উত্তর না পাইয়া সে আবার তাঁহার পা দুইটি চাপিয়া ধরিল। আর রায়ের সহ্য হইল না, প্রচণ্ড ক্রোধে তিনি ফাটিয়া পড়িলেন, রংলালের মুখে সজোরে লাথি মারিয়া আপনার পা ছাড়াইয়া লইলেন। সেই আঘাতে রংলালের সম্মুখের দুইটা দাঁত উপড়াইয়া গিয়া তাহার নির্বোধ মুখখানাকে রক্তাক্ত করিয়া দিল।
হেমাঙ্গিনী কিছু বলিতে সাহস করেন নাই, কিন্তু উমা করিল। বাপের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ছি ছি ছি, এ কি করলে বাবা? সে যাই হোক, সে তো মানুষ!
রায় নীরবে ঘরের মধ্যে একা পদচারণা করিতেছিলেন, তিনি থমকাইয়া দাঁড়াইলেন, মেয়ের মুখের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন, পাপ করেছি মা। মানুষ আমি, মতিভ্রম হয়েছিল। কিন্তু রংলালের পায়ে ধরে প্রায়শ্চিত্ত তো করতে পারব না।
এ কথার উত্তরে উমা আর কিছু বলিতে পারিল না, সে যেন এতটুকু হইয়া গেল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া রায় ডাকিলেন, তারা, তারা মা!
উমা এবার লজ্জিত হইয়া কুণ্ঠিত স্বরে বলিল, আপনি একটু বসুন বাবা, আমি বাতাস করি।
রায় হাসিলেন, কিন্তু কন্যার কথা উপেক্ষা করিলেন না, বসিলেন। বসিয়া বলিলেন, মানুষের দিন যখন শেষ হয়, তখন অমনি করেই মতিভ্রম হয়। আমাদের দিন শেষ হয়েছে মা।
উমা শিহরিয়া উঠিল, ও কি বলছেন বাবা?
মরণের কথা বলছি না মা, আমাদের সুদিনের কথা বলছি। চাষীরা সব আমাদের বিপক্ষ হয়ে কলের মালিকের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। অথচ একদিন খুন করলেও তারা আমাদের বিপক্ষে কথা বলে নি, বিচার বলে মেনে নিয়েছে।
উমা চুপ করিয়া রহিল।
রায় বলিলেন, আজ একটা কথা মুখ দিয়ে বের করতে লজ্জার আমার মাথা কাটা যাচ্ছে মা। অথচ তোর শ্বশুর-শাশুড়ীকে বলতেই হবে। তুই-ই সে কথাটা বলে দিবি মা।
কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা করিয়া উমা বলিল, বলুন।
চরের সমস্ত মকদ্দমায় আমাদের হার হয়েছে মা।
উমা একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, বলব।