রায়-বাড়ির ও চক্রবর্তী-বাড়ির পাইকদের না আসিবার কারণ ছিল। তাহারা আর কোনদিন আসিবে না। চর লইয়া জমিদার ও কলের মালিকের দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটিয়াছে। জমিদারপক্ষ সমস্ত মামলায় হারিয়া গিয়াছেন। গত কাল অপরাহ্নে বিচারকের রায় বাহির হইয়াছে, সংবাদটা এখনও সকলের মধ্যে প্রচারিত হয় নাই।
মামলার পরাজয়ের সংবাদ সুনীতিও জানিতেন না। ইন্দ্র রায় সে সংবাদ এখন তাঁহাকে জানাইতে পারেন নাই, সুনীতি কেন, হেমাঙ্গিনীকেও জানাইতে তাহার বাধিয়াছে। কলের মালিক কলের লাঙল চালাইয়া চর দখল করিতেছেন। সংবাদ পাইয়া সুনীতি নূতন দাঙ্গা-হাঙ্গামার আশঙ্কায় উদ্বেগে অস্থির হইয়া উঠিলেন। ভাঁড়ার বাহির করিতে গিয়া তাঁহার হাত কাঁপিতেছিল। নীরবে নতমুখে বাঁটির উপর বসিয়া উমা শ্বশুরের জন্য আনারস ছাড়াইয়া কুটিতেছিল। এমন সময় মানদা ছড়া কাটিয়া ভণিতা করিয়া বাড়ি ফিরিল; সেও কলের লাঙল দেখিতে গিয়াছিল। চোখ দুইটি বড় করিয়া গালে হাত দিয়া বলিল, ‘যা দেখি নাই বাবার কালে, তাই দেখালে ছেলের পালে! কালে কালে আরও কত হবে, বেঁচে থাকলে আরও কত দেখব।
সুনীতি ব্যাগ্রভাবে প্রশ্ন করিলেন, কোনও খুনখারাপি হয় নি তো?
না গো না। কেউ যায়ই নাই। দিব্যি কলের লাঙল চালিয়ে এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো পর্যন্ত চষে নিলে কলওয়ালা।
সুনীতি পরম স্বস্তিতে একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিলেন। মানদার আসল বক্তব্য তখনও শেষ হয় নাই। সে বলিয়াই গেল, গরু নাই, মোষ নাই, চাষা নাই, লাঙলের ফাল নাই-এই একটা গাড়ির মতন, ফটফট শব্দ করে চলেছে, আর জমি চাষ হয়ে যাচ্ছে। এক দণ্ডে এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত চাষ হয়ে গেল।
উমা মৃদু হাসিয়া বলিল, ওটা হল মোটরের লাঙল, মোটর গাড়ি তো আপনি চলে দেখেছ, এও তেমনি চলে। নীচে বড় বড় ধারালো ইস্পাতের ছুরি লাগানো আছে, মোটরটা চলবার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো মাটি কেটে উলটে দিয়ে যায়।
মানদা সবিস্ময়ে মৃদুস্বরে বলিল, তাই সবাই বলছে বৌদিদি। আর ধোঁয়া ছাড়ছে কলটা, তার গন্ধ নাকি অবিকল মোটরের ধোঁয়ার গন্ধের মত। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া আবার সে বলিল, আঃ, অনাথা গরু-মোষের অন্নই মারা গেল, আর কি!
সকৌতুকে উমা মানদার দিকে চাহিল, মানদা বলিল, গরু-মোষ তো আর কেউ পালাবে না বৌদিদি, না খেতে পেয়েই ওরা মরে যাবে!
উমা এবার বেশ একটু জোরেই হাসিয়া উঠিল। সুনীতি মৃদু হাসিয়া বলিলেন, তা এতে এমন করে হাসছ কেন বউমা? ও-বেচারার যেমন বুদ্ধি তেমনি বলছে।
মানদা একটা সমর্থন পাইয়া বেশ জাঁকিয়া উঠিয়া কি বলিতে গেল, কিন্তু নবীন বাগদীর স্ত্রী মতি বাগদিনী হন্তদন্ত হইয়া বাড়ির মধ্যে আসিয়া পড়ায় সে-কথা তাহার বলা হইল না। মতির মুখে প্রচণ্ড উত্তেজনাভরা উচ্ছ্বাস; সে বাড়িতে প্রবেশ করিয়াই ডাকিল, রাণীমা!
কি রে? কি হয়েছে বাগদীবৌ? সুনীতি শঙ্কিত হইয়া প্রশ্ন করিলেন। চরে কি আবার
চরে নয় মা, রংলাল মোড়লের এক-পাটি দাঁত লাথি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন রায়হুজুর।
সে কি? কেন?
ওই চরের জমির লেগে মা। চরের জমি লিয়ে চাষীরা নাকি কলের সায়েবের সঙ্গে কি ষড় করেছিল। সায়েব আজ চর দখল করেছে কিনা! তাই জানতে পেরে
সুনীতির মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল। ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। রংলালের মুখ তাহার মনে পড়িয়া গেল, নির্বোধ দৃষ্টি, ঘোলাটে চোখ, পুরু ঠোঁটে বিনীত তোষামোদভরা হাসি; আহা সেই মানুষকে! টপ টপ্ করিয়া চোখের জল মাটির উপর ঝরিয়া পড়িল।
উমা বটি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, সে জমিদার-কন্যা জমিদার বধু হইলেও নবীন যুগের মেয়ে, তাহার উপর মুহর্তে তাহার মনে পড়িয়া গেল অহীন্দ্রকে। মানুষের মুখে লাথি মারার কথা শুনিয়া সে যে কি বলিবে, হয়তো কিছু বলিবে না, কিন্তু অদ্ভুত দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিবে, ক্ষুরধার মৃদু হাসি হাসিবে। সে বলিল, আমি একবার ও-বাড়ি যাব মা।
সুনীতি বলিলেন, মানদা, সঙ্গে যা মা। তুমি দেখো বউমা, আর যেন কোন উৎপীড়ন না হয় গরীবের ওপর। বলো, ও-চর আমি চাই না, ও যাওয়াই ভাল।
উমা ও মানদা চলিয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে মতিও গেল। মতি এখন সাধ্যমত প্রহরিণীর কাজ করিয়া স্বামীর কাজ বজায় রাখিবার চেষ্টা করে। প্রয়োজন হইলে লাঠি হাতে লইতেও লজ্জিত হয় না।
সুনীতি স্তব্ধ উদাস হইয়া বসিয়া রহিলেন।
সর্বনাশা চর! ওই চরের জন্যই এত। তাহার মনে পড়িল, এই লইয়া দ্বন্দ্বের প্রথম দিন হইতে রংলাল জড়িত আছে। খানিকটা জমির জন্য বেচারা চাষীর কি লোলুপ আগ্রহ! নবীনদের দাঙ্গার মকদ্দমাতেও রংলাল জড়িত ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতচমকের মত মনে পড়িয়া গেল একদিনের কথা। নবীনদের মকদ্দমার সময়েই একদিন তিনি চরটাকে যেন ঘুরিতে দেখিয়াছিলেন; এই বাড়িটাকেই কেন্দ্র করিয়া চক্রান্তের চক্র সৃষ্টি করিয়া ঘুরিতেছিল। সেটা কি আজও ঘুরিতেছে? নইলে ওই নিরীহ চাষীর মুখ দিয়া এমন করিয়া রক্ত ঝরিয়া পড়িল কেন? সর্বনাশা চর!
তাহার ভাবপ্রবণ অনুভূতিকাতর মন শিহরিয়া উঠিল। না, ও-চরের সঙ্গে আর কোন সংস্রব তিনি রাখিবেন না। অহীন্দ্রকে তিনি আজই পত্র লিখিবেন, সে আসুক, চর বিক্রয় করিবার জন্য সে আসুক।