উমা চলিয়া গেল, উহার নাম উচ্চারণে রামেশ্বরও সংযত হইয়া উঠিলেন।
রায় হাসিতেছিলেন, তিনিও অকস্মাৎ গম্ভীর হইয়া কাজের কথা পাড়িয়া বসিলেন, এমনি একটা সুযোগের প্রতীক্ষাই যেন তিনি করিতেছিলেন। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকিয়া গলা ঝাড়িয়া লইয়া তিনি বলিলেন, রামেশ্বর, তোমার সঙ্গে কয়েকটি জরুরী বিষয় আলোচনার জন্য এসেছি।
গম্ভীরভাবেই রামেশ্বর হাসিলেন, বলিলেন, চক্ষুষ্মান পথভ্রান্ত হলে নিরুপায়ে অন্ধের কাছেও পথ জিজ্ঞাসা করে। কি বলছ, বল? দিক বলতে না পারি, সম্মুখ পশ্চাৎ দক্ষিণ বাম-এগুলো বলতে পারব। পথের পারিপার্শ্বিক চিহ্নের কথা বলতে পারব না, তবে বন্ধুরতার বিষয় বলতে পারব।
রায় বলিলেন, মানমর্যাদা নিয়ে মকদ্দমা, অথচ টাকার অভাব হয়ে পড়ল রামেশ্বর! আমার হাত পর্যন্ত শুকনো হয়ে এল। এ ক্ষেত্রে রামেশ্বর বলিলেন, অধর্মকে বর্জন করে সাক্ষাৎ নারায়ণরূপী রামের শরণাপন্ন হয়েও বিভীষণ অমর হয়ে কলঙ্ক বহন করেছেন। মামলা শেষ পর্যন্ত লড়তেই হবে ইন্দ্র। টাকা না থাকে ঋণের ব্যবস্থা কর।
না। রায় গম্ভীরভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না। ঋণ করতে গেলে শেষ পর্যন্ত ওই কলওয়ালার কবলস্থ হতে হবে। লোকটা ধরাট দিয়েও সে-খত কিনবে। সুদখোরের মত ধূর্ত এবং লোভী এ সংসারে আমি তো কাউকে দেখি না, তারা অর্থের লোভে সব করতে পারে; এ খত তো তারা বিক্রি করবেই!
রামেশ্বর স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। রায় বলিলেন, মহলে যে-সব খাস জোত আছে, তারই কিছু বন্দোবস্ত করে দেওয়াই কি ভাল নয়?
রামেশ্বর কোন উত্তর দিলেন না। তিনি চিন্তা করিতেছিলেন, কিছুক্ষণ পরেই তাঁহার দুর্বল মস্তিষ্কে সব যেন গোলমাল হইয়া গেল। শূণ্য অর্থ হীন স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া তিনি বসিয়া রহিলেন।
রায় তাহাকে ডাকিলেন, রামেশ্বর! রামেশ্বর নড়িয়া চড়িয়া বসিলেন, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ইন্দ্র!
তা হলে তাই করি, কি বল?
অনেকক্ষণ ধরিয়া কথাটা স্মরণ করিয়া সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, হ্যাঁ, সেই ভাল। ঋণ-না ভাল নয়। শেষ পর্যন্ত বডি ওয়ারেন্ট করে।
.
বাতাসেরও কান আছে। জমি বন্দোবস্তের কথা প্রকাশ করিয়া জানাইতে হইল না। অথচ সমস্ত গ্রামময় কথাটা রটিয়া গেল।
দুই-তিন দিন পরেই গ্রামের চাষীরা ছুটিয়া আসিয়া পড়িল, ‘জমি যখন বন্দোবস্তই করবেন, তখন চরের ওই ভাগে-বিলি-করা জমিটা আমাদের বন্দোবস্ত করিয়া দিন। এক-শ বিঘা জমির বিঘা-পিছু ত্রিশ টাকা হিসাবে সেলামী এবং দুই টাকা হারে খাজনা দিতে আমরা প্রস্তুত।’ দলটির সর্বাগ্রে ছিল রংলাল।
রায় ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, এত টাকা তোরা পাবি কোথায়?
রংলাল বলিল, আজ্ঞে, আমরা তিরিশ জনায় লোব। জনাহি একশ টাকা আমরা যোগাড় কোনরকমে করব।
গভীর ব্যগ্রতায় সে রায়ের পা দুইটি জড়াইয়া ধরিল, হেই হুজুর। নইলে এ চরণ আমরা কিছুতেই ছাড়ব না।
রায় বিবেচনা করিয়া দেখিলেন, এত বেশী টাকা অন্য মহলে জমি বন্দোবস্ত করিয়া পাওয়া যাইবে না। তা ছাড়া চাষীরাও গোলাম হইয়া থাকিবে।
যোগেশ মজুমদার আসিয়া পাঁচ হাজার টাকা সেলামী দিতে চাহিল, কিন্তু রায় হাসিয়া বলিলেন, না!
.
৩৩.
আরও মাস তিনেক পর।
মাঘ মাসের প্রথমেই একদিন প্রাতঃকালে কলের মালিক অকস্মাৎ সমস্ত চরটাই দখল করিয়া বসিলেন, রংলাল-প্রমুখ চাষীরা যে-জমিটা অল্পদিন পূর্বে জমিদারের নিকট বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছিল। সে অংশটা পর্যন্ত দখল করিয়া লইলেন।
মোটর-সংযুক্ত বিলাতী লাঙল চালাইয়া চরের সমস্ত আবাদী জমি এ-প্রান্ত হইতে ও-প্রান্ত পর্যন্ত চষিয়া এক করিয়া দিল। সংবাদ পাইয়া সমস্ত রায়হাট গ্রামখানাই বিস্ময়ে কৌতূহলে উত্তেজনায় মাতিয়া উঠিল। চরের উপর কলের লাঙল আসিয়াছে। গরু নাই, মহিষ নাই, কোন লোক লাঙলের মুঠা ধরিয়া নাই, অথচ চাষ হইয়া চলিয়াছে। কেবল একজন লোক গাড়ির মত কলটার উপর বাবুর আরামে বসিয়া আছে, হাতে পায়ে দু-একটা কল ঘুরাইতেছে টিপিতেছে, আর গাড়িটা চলিতেছে, পিছনে ইয়া মোটা মোটা মাটির চাঁই উল্টাইয়া পড়িতেছে। ওটা নাকি মোটরের লাঙল, ঠিক মোটরের ধোঁয়া ছাড়ে শব্দ করে। ভটভট শব্দ করিয়া বুনো শূকরের মত এ-প্রান্ত হতে ও-প্রান্ত ছুটিয়া চলিয়াছে; বাধাবিঘ্ন বলিয়া কিছু নাই, উঁচু-নীচু খাল-টিপি সব উখড়াইয়া দিয়া চলিয়াছে।
গ্রামের অবালবৃদ্ধ কালিন্দীর ঘাট হইতে চর পর্যন্ত ভিড় জমাইয়া ছুটিয়া আসিল। বনিতারা সকলে না আসিলেও অনেকে আসিয়াছিল। তাহারা কালিন্দীর এ-পারেই দাঁড়াইয়া ছিল। চাষীদের বউগুলি দাঁড়াইয়া ঘোমটার অন্তরালে কেবলই কাঁদিতেছিল। তাহারা কল দেখিতে আসে নাই, তাহারা দেখিতেছিল, তাহাদের। জমি চলিয়া যাইতেছে। দূরান্তর হইতে প্রিয়জনের মৃত্যুশয্যার শিয়রে যেমন মানুষ আসিয়া অঝোরঝরে কাঁদে, আর নির্নিমেষ নেত্রে মৃত্যুপথযাত্রীর দিকে চাহিয়া থাকে, এ দেখিতে আসা তাহাদের সেই দেখিতে আসা। তাহাদের চোখে সেই মমতাকাতর দৃষ্টি। চাষীরা কিন্তু আসে নাই। সমবেত জনতা প্রতি মুহূর্তে প্রত্যাশা করিতেছিল, চাষীদের সঙ্গে ছোট রায়-বাড়ি ও চক্রবর্তী-বাড়ির পাইকেরা রে রে করিয়া আসিয়া পড়িল বলিয়া। কিন্তু বহুক্ষণ চলিয়া গেল, তবু কেহ আসিল না। ও-দিকে চরটা সমস্তই চষিয়া ফেলিয়া কলটা স্তব্ধ হইল।