অহীন্দ্র স্তব্ধ হইয়া রহিল। মা আবার বলিলেন, প্রথমে ভেবেছিলাম, তুই বুঝি আমার কাছ থেকেই সরে গেছিস। বৌমা-। কণ্ঠস্বরে তাঁহার লজ্জার রেশ ফুটিয়া উঠিল, বলিলেন, বিয়ের পর বৌয়ের ওপর ছেলের একটা টান হয়, তখন মায়ের কাছ থেকে ছেলে একটু সরে যায়। আমি ভেবেছিলাম তাই। কিন্তু বৌমার মুখ দেখে বুঝলাম, তাও তো নয়। মাঝে মাঝে তার হাসিমুখ দেখি, কিন্তু আবার দেখি তার মুখ শুকনো। আমি বেশ লক্ষ্য করে দেখেছি অহীন, শুকনো মুখই তার বেশির ভাগ সময় চোখে পড়ে।
অহীন যেমন স্তব্ধ হইয়া ছিল, তেমনি স্তব্ধ হইয়া রহিল। কিছুক্ষণ উত্তরের প্রতীক্ষা করিয়া মা বলিলেন, উমা তো অপছন্দের মেয়ে নয় অহীন।
না মা, না। উমাকে নিয়ে আমি অসুখী নই তো। অহীন্দ্রের কণ্ঠস্বরে আন্তরিক শ্রদ্ধার আভাস ফুটিয়া উঠিল।
তবে? মা প্রশ্ন করিলেন, তবে?
তবে? কি উত্তর আমি দেব মা? কথা শেষ করিয়া মুহূর্ত পরে সে সচকিত হইয়া উঠিল, বলিল, তুমি কাঁদছ মা? তাহার কপালের উপর অশ্রুবিন্দুর উষ্ণ স্পর্শে সে চমকিয়া উঠিল।
মা বলিলেন, নিরুচ্ছ্বসিত অথচ উদাস কণ্ঠস্বরে, জানি নে তুই আমার কাছে লুকোচ্ছিস কি না, কিন্তু সমস্ত চেহারার মধ্যে এক নতুন মানুষ ফুটে উঠছে অহীন। তুই কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এর মধ্যে নিজেকে ভাল করে দেখিস নি? আমার সর্বশরীর শিউরে ওঠে মধ্যে মধ্যে তোর চোখের দৃষ্টি দেখে।
অহীন্দ্র বলিল, আমি আজকাল একটু বেশী চিন্তা করি। সে কথা সত্যি। কিন্তু আমার দৃষ্টির কথা কিংবা আমি নাগালের বাইরে, এ-সব তোমার কল্পনা মা।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মা বলিলেন, কি জানি! কিন্তু আমার মন কেন এমন হয়ে উঠেছে অহীন? যেন আমার কত দুঃখ কত শোক! দুঃখ আমার অনেক, কিন্তু যাদের জন্য দুঃখ, তাদের মুখ তো মনে পড়ে না আমার। তোর মুখই কেন চোখের ওপরে ভেসে ওঠে?
জীবনে তুমি আঘাত পেয়েছ মা, সে আঘাতের বেদনা এখনও তুমি সহ্য করে উঠতে পার নি, ও-সব চিন্তা তারই ফল। তুমি কেঁদো না, তোমার কান্না আমি সইতে পারি নে।
কিন্তু তুই এত কি ভাবিস, আমায় বল্ দেখি?
ভাবি? অহীন্দ্র হাসিল, বলিল, তুমি যা ভাবতে শিখিয়েছ, তাই ভাবি। আর কি ভাবব? ভাবি, মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা। মানুষ মানুষের ওপর অন্যায় অত্যাচার করে, সেই কথা ভাবি।
সুনীতি নীরব হইয়া বসিয়া রহিলেন। দুঃখ তাহার গেল না কিন্তু শোকের মধ্যে সান্তনার স্নেহস্পর্শের মত সন্তানগর্বের একটি নিরুচ্ছ্বসিত আনন্দ তাঁহার মনে জাগিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ পর বলিলেন, আশীর্বাদ করি, তুই মানুষের দুঃখ দূর কর।
আবার তাঁহার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল; কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছিয়া তিনি বলিলেন, সেই সঙ্গে মনে রাখিস বাবা, আমরা- আমি, উমা
মা! মা রয়েছেন নাকি? আচ্ছা মানুষ বাপু আপনি। সুনীতির কথায় বাধা দিয়া মানদা ঝি ঝঙ্কার দিতে দিতে ছাদের দরজার মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; কথার সুর ও ভঙ্গির মধ্যে বক্তব্যের স্বরূপের একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকে, মানদার কথায় সুনীতি ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, কি রে মানদা?
বাবা! এই অন্ধকারে মায়ে-পোয়ে ছাদে বসে রয়েছেন, তা কি করে জানব বলুন? সারা বাড়ি খুঁজে হয়রান। দাদাবাবুর শ্বশুর এসেছেন, শাশুড়ী এসেছেন, খুঁজছেন আপনাকে। দাদাবাবুর সম্বন্ধী এসেছেন।
ব্যস্ত হইয়া সুনীতি বলিলেন, নীচে আয় অহীন;-বলিয়া তিনি অগ্রসর হইলেন, অহীন্দ্রও তাঁহার অনুসরণ করিল। কোথাও কিছু পড়িয়া আছে কিনা দেখিতে দেখিতে মানদা আপন মনেই বলিল, কথায় বলে ‘কাতির শিশিরে হাতি পড়ে’। কার্তিক মাসে শিশির মাথায় করে এই অন্ধকারে–আচ্ছা মানুষ বাবা।
***
রায় আসিয়াছিলেন বৈষয়িক প্রয়োজনে, মামলা পরিচালনা সম্পর্কে একটি বিশেষ পরামর্শ করিবার প্রয়োজন হইয়াছে। রামেশ্বরের ঘরে তিনি বসিয়া আছেন। ঘরের মধ্যে মৃদু প্রদীপের আলো তেমনি জ্বলিতেছে, রামেশ্বর খাটের উপর বসিয়া রহিয়াছেন। রায়ের অদূরে রামেশ্বরের খাটের সম্মুখে অতি নিকটেই বসিয়া আছেন হেমাঙ্গিনী; উমা ঘরের কোনে টেবিলের উপর বই গুছাইয়া রাখিতেছে। শ্বশুর ও পুত্রবধূতে মিলিয়া কাব্যলোচনা হইতেছিল। উমার কল্যাণে রামেশ্বর অল্প একটু সুস্থ হইয়া উঠিয়াছেন। সুনীতি যখন ঘরে প্রবেশ করিলেন, তখন সদ্য কোন হাস্যপরিহাস শেষ হইয়াছে, সকলের মুখেই হাসির রেখা ফুটিয়া রহিয়াছে। হেমাঙ্গিনী অপ্রতিভ মুখে হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, কথায় আপনার সঙ্গে কেউ পারবে না। আমি হার মানছি।
রামেশ্বর হাসিয়া বলিলেন, তা হলে আপনার কাছে আমার মিষ্টান্ন প্রাপ্য হল।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, মিষ্টান্ন আমাকেই আপনার খাওয়ানো উচিত, কারন আপনি জিতেছেন।
রামেশ্বর হাসিয়া একটি কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আপানার কথায় বড়ই দুঃখ পেলাম দেবী। রায় হল রাজশব্দের অপভ্রংশ; রায়-গিন্নী আপনি, আপনি হলেন রাণী। মিষ্টান্ন বস্তুটা চিরদিন রাণী এবং রাজকূল কথায় পরাজিত হয়ে বয়স্যগণকে করস্বরূপ প্রদান করে এসেছেন। আজ সেই বস্তুর দিকে যদি আপনার হস্ত প্রসারিত হয়, তবে সে হস্তকে রাজহস্তে সমর্পণ করা ছাড়া তো গত্যন্তর দেখি না।
হেমাঙ্গিনী ঘরের মধ্যে উমার অস্তিত্ব স্মরণ করিয়া লজ্জিত হইয়া পড়িলেন, তাহাকে সরাইয়া দিবার জন্যই বলিলেন, উমা, অমল বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দে তো মা।