হেমাঙ্গিনী বলিলেন, যাব; এখনই অমল এল, তাকে জল খাইয়ে তারপর যাব। ছেলে বাড়ি এল, তার খোঁজ করা নেই, মামলা নিয়েই মেতে আছ! ধন্য মানুষ তুমি!
রায় বললেন, আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে অমলের। তিনি হাসিলেন, সে হাসিটুকু একান্ত ভাবে দোষক্ষালনের জন্য অপ্রতিভের হাসি। তারপর তিনি বলিলেন, কই অমল কই? একখানা আইনের বইয়ের জন্য লিখেছিলাম-অমল! অমল!–বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে তিনি উপরে উঠিয়া গেলেন, পদক্ষেপে সিঁড়িটা যেন কাঁপিতেছিল।
হেমাঙ্গিনী সুনীতির কাছে আসিয়া উমার সহিত নির্জনে দেখা করিলেন। অমলের কথা শুনিয়া অবধি উমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করিবার জন্য তিনি ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছিলেন।
উমা একটু বিস্মিত হইল-এমন নির্জনে মা কি বলবেন? হেমাঙ্গিনী বলিলেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব উমা। সত্যি বলবি তো? আমার কাছে লুকাবি নি তো?
কি মা?
হ্যাঁরে অহীন তোকে চিঠিপত্র লেখে তো?
লজ্জিত হইয়া উমা সবিস্ময়ে বলিল, লেখে বৈকি মা।
বেশ ভাল করে লেখে তো?
উমা হাসিয়া ফেলিল। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, অমল বলছিল, অহীন নাকি তার সঙ্গে ভাল করে মেশে না। তার নাকি অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
উমা গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তারপর বলিল, তিনি অনেক কথা ভাবেন মা। অনেক বড় বড় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সেই জন্য বোধ হয়
কন্যার গৌরববোধ দেখিয়া মা তৃপ্ত হইলেন। আর কোন প্রশ্ন করিলেন না।
***
হেমাঙ্গিনী তখনকার নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু পূজার ছুটিতে অহীন্দ্র বাড়ি আসিলে তাহাকে দেখিয়া তিনি মনে মনে শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। অহীন্দ্রের দেহ শীর্ণ হইয়া গিয়াছে, মাথার চুল বিশৃঙ্খল, শরীরের প্রতি অমনোযোগের চিহ্ন সুপরিস্ফুট, অমনোযোগ না বলিয়া অত্যাচার বলিলেও অন্যায় হয় না। তাহার শীর্ণ দেহের মধ্যে চোখ দুইটি শুধু জ্বলজ্বল করিতেছে, কৃষ্ণপক্ষের রক্তাভ যুগল মঙ্গল গ্রহের মত।
তিনি সস্নেহে অহীন্দ্রের মাথায় হাত বুলাইয়া বলিলেন, শরীর তোমার এত খারাপ কেন বাবা?
অল্প একটু হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, শরীর? তারপর আবার একটু হাসিল, আর কোন উত্তর দিল না, যেন হাসির মধ্যেই উত্তর দেওয়া হইয়া গিয়াছে।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, হাসির কথা নয় বাবা, শরীর বাঁচিয়েই সকল কাজ করতে হয়। এই গোটা সংসারটি তোমার মুখপানে তাকিয়ে আছে।
অহীন আবারও একটু হাসিল।
হেমাঙ্গিনী যাবার সময় কন্যাকে সতর্ক করিয়া দিলেন, উমা, তুই একটু যত্নটত্ন কর ভাল করে।
উমা মাথা হেঁট করিয়া নীরব হইয়া রহিল। হেমাঙ্গিনী বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, আমাদের কালের ঘোমটা দেওয়া কলাবৌ তো নস্। বেশ করে রাশ একটু বাগিয়ে ধরবি, তবে তো।
হেমাঙ্গিনী চলিয়া গেলে উমা মৃদু হাসিয়া ঘরে প্রবেশ করিল, অহীন্দ্র বলিল, সুস্বাগত বাঙালিনী!
গুড আফ্রন্টারনুন সায়েব। চমৎকার শরীরের অবস্থা কিন্তু সায়েবের!
বাঙালিনীর অভাবে সায়েবের এই অবস্থা। এখন তো কাছে পেয়েছ, এইবার বেশ গ্রামফেড মাটন করে তোল।
উমা হাসিয়া বলিল, উঁহু মাটন না, ওয়েল-ফেড হর্স। মা বলে গেলেন রাশ টেনে ধরতে। হাড়পাঁজরা ঝুরঝুরে আকাশে-ওড়া পক্ষিরাজকে মাটিতে নামতে হবে।
এবং নাদুসনুদুস হয়ে বাঙালিনীকে পিঠে নিয়ে গ্রুপথুপ করে চলতে হবে।
ঘর পরিস্কার করিয়া বিছানা করিবার জন্য দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইল মানদা। উমা একটু সারিয়া দাঁড়াইল। মানদা অহীন্দ্রকে দেখিয়া গালে হাত দিয়া বলিল, কি চেহারা হয়েছে দাদাবাবু!
সুনীতি কিছু বলিলেন না, কেবল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ছেলের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। কয়েক দিন পরেই উমাও যেন কেমন শুষ্ক বিশীর্ণ হইয়া উঠিল। সেও সুনীতি দেখিলেন।
অবশেষে একদিন রাত্রির অন্ধকারে মা আসিয়া ছেলের সম্মুখে দাঁড়াইলেন। কোজাগরী পূর্ণিমা পার হইয়া গিয়াছে, সম্মুখে অমাবস্যা আগাইয়া-আসিতেছে, সেই অন্ধকারের মধ্যে ছাদে অহীন্দ্র একা বসিয়া ছিল। এমনই করিয়া সে এখন একা অন্ধকারে বসিয়া থাকে। কাছারিপ্রাঙ্গনের নারিকেল-বৃক্ষশীর্ষগুলি ছাদের আলিসার অল্প দূরে শূণ্যলোকে জটাজুটময় অশরীরীবৃন্দের মত স্তব্ধ হইয়া-যেন সভা করিয়া বসিয়া আছে; ঝাউগাছ দুইটার শীর্ণ দীর্ঘতময় শীর্ষদেশ হইতে ছেদহীন কাতর দীর্ঘশ্বাস ঝরিয়া পড়িতেছে। তাহারই মধ্যে সুনীতি নিঃশব্দে অহীন্দ্রের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। অহীন্দ্র জানিতে পারিল না।
সুনীতি ডাকিলেন, অহীন!
চমকিত অহীন্দ্র মুখ ফিরাইয়া বলিল, মা?
হ্যাঁ, আমি।
এস মা, বস। কিছু বলছ?
বলব। অন্ধকারে অহীন্দ্র মায়ের মুখ দেখিতে পাইল না, কিন্তু কণ্ঠস্বরের সুরে সে বেশ অনুভব করিল যে, তাঁহার মুখে সেই বিচিত্র করুণ হাসি ফুটিয়া উঠিয়াছে, যে হাসি তাহার মা ছাড়া বোধহয় এ পৃথিবীতে কেহ হাসিতে পারে না।
সুনীতি ছেলের পাশে বসিলেন, তাহার মাথাটি আপনার কোলের উপর টানিয়া লইয়া রুক্ষ চুলগুলি সযত্নে বিন্যস্ত করিয়া দিয়া বলিলেন, তোর কি হয়েছে বাবা?
কিছুই তো হয় নি। অহীন্দ্রের কণ্ঠস্বরে কপটতার লেশ ছিল না।
তবে?
কি মা?
তুই আমাদের কাছ থেকে এমন দূরে চলে যাচ্ছিস কেন বাবা?
দূরে চলে যাচ্ছি!-সবিস্ময়ে অহীন্দ্র প্রশ্ন করিল।
হ্যাঁ। মা বলিলেন, হ্যাঁ, দূরে চলে যাচ্ছিস, আমরা যেন তোর নাগাল পাচ্ছি নে।