.
৩২.
ইহার পর বিরাট একটি মামলা-পর্ব।
সাঁওতালদের জমি এবং নদীর বাঁধ উপলক্ষ করিয়া কলওয়ালার সহিত ইন্দ্র রায় ও চক্রবর্তী-বাড়ির ছোট-বড় ফৌজদারী দেওয়ানী মামলা একটির পর একটি বাধিয়া চলিতে আরম্ভ করিল।
সদর হইতে এস.ডি.ও আসিয়া তদন্ত করিয়া গেলেন। অমলের আনীত অভিযোগ তিনি প্রত্যক্ষ করিলেন, সাঁওতালরা ভূমিহীন হইয়া অধিকাংশই এখান থেকে চলিয়া গিয়াছে, যাহারা আছে তাহাদেরও জমিজমা নাই। কিন্তু ইহাদের মধ্যেও তিনি বে-আইনী কিছু দেখিলেন না। বিমলবাবু ঋণের দায়ে জমিগুলি খরিদ করিয়াছেন, সাঁওতালরাও স্বেচ্ছায় বিক্রয় করিয়াছে। চূড়া মাঝি ও তাহার অনুগত মাঝি কয়জন-যাহারা এখানে থাকিয়া গিয়াছে, তাহারাই সে কথা স্বীকার করিল। সারী-সম্পর্কিত অভিযোগের তদন্ত করিয়া তিনি যাহা দেখিলেন, সে কথা সত্যের খাতিরেও পুরোপুরি লেখা চলে না।– ‘বর্বর জীবনের সঙ্গে লোভ এবং নীতিহীন উজ্জ্বলতার সম্বন্ধ অতি ঘনিষ্ট; এক একটা জীবনে তাহা অত্যুগ্র হইয়া আত্মপ্রকাশ করিয়া থাকে, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বর্বর লোভপরবশ, উজ্জ্বল মেয়েটির এই পরিণতি ভয়াবহরূপে দুঃখজনক হইলেও ইহা স্বাভাবিক। তাহার বর্তমান অবস্থা হইতে তাহা প্রত্যক্ষ, কিন্তু সে অবস্থার কথা লেখা চলে না।’
মোটামুটি অভিযোগের বিষয়গুলি বাহ্যত প্রত্যক্ষ হইলেও অন্তর্নিহিত সত্য ইহার মধ্যে কিছুই নাই; ইহার অন্তর্নিহিত সত্য হইতেছে জমিদারের সহিত কলের মালিকের প্রতিপত্তি লইয়া বিরোধ। কলের মালিক এখানে কল স্থাপন করিয়া সমগ্র অঞ্চলের একটি বিশেষ উপকার করিয়াছেন। দীনদরিদ্রের মজুরির সুবিধা হইয়াছে, আখের চাষের উন্নতির বিশেষ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; চারিদিকের পথঘাটের উন্নতি হইয়াছে, এবং এ-কথাও সত্য যে, জমিদারের প্রাপ্য ন্যায্য খাজনা বন্ধ করিয়া কলের মালিক আইন বাঁচাইয়াও যথেষ্ট অন্যায় করিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে, কোন স্থানের প্রজারা সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া ধর্মঘট করিলে যে বিশৃঙুলা ঘটিত, এ-ক্ষেত্রে একক তিনি কৌশলে সেই বিশৃঙ্খলা ঘটাইয়াছেন।’
কিন্তু ইহাতেও কোন ফল হইল না।
উভয় পক্ষই একটির পর একটি নূতন বিবাদ বাধাইয়া চলিলেন। ইন্দ্র রায়ের স্বাভাবিক জীবন আর। একরকম হইয়া উঠিল, তাঁহার গোঁফজোড়াটা পাক খাইয়া ভোজালির মত বাঁকা এবং তীক্ষাগ্র হইয়া উঠিয়াছে। জমিদারী কাগজপত্র ও ফৌজদারী দেওয়ানী আইনের বইয়ের মধ্যে তিনি ডুবিয়া আছেন। অন্দরমহল পর্যন্ত এ উত্তেজনা সঞ্চারিত হইয়া পড়িয়াছে। নিত্য প্রভাবে আজ আবার নূতন কি ঘটিবে, তাহারই আশঙ্কায় চিন্তায় সকলে কল্পনা-মুখর মস্তিষ্কে শয্যাত্যাগ করিয়া থাকেন।
অহীন্দ্র অমল কলিকাতায়। অমল ভালভাবেই আই.এ পাস করিয়া বি.এ পড়িতেছে; অহীন্দ্র পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। সে নাকি খাড়া সোজা হইয়া বিদ্যা সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়া ডুবিয়াছে। অমল ইহার মধ্যে বারদুয়েক বাড়ি আসিল, কিন্তু অহীন্দ্র আসিল না।
হেমাঙ্গিনী অভিযোগ করিয়া বলিলেন, তাকে ধরে নিয়ে এলি নে কেন তুই?
অমল ভুরু কুঁচকাইয়া বলিল, সে হল বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন- হীরের টুকরো; আমার হলাম কয়লার কুচো। সম্বন্ধ ঘনিষ্ট হলেও তার স্থান হল সোনার গহনায়, আর আমাদের স্থান চুলোয়। তার নাগাল আমি পাব কেমন করে, বল?
হেমাঙ্গিনী একটু আহত হইয়া চুপ করিয়া রহিলেন। একটু নীরব থাকিয়া অমল আবার বলিল, জান মা, অহীন আজকাল আমার সঙ্গে ভাল করে মেশেই না। তার এখন সব নূতন সঙ্গী জুটেছে, অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে অহীনের।
হেমাঙ্গিনী দুঃখ অনুভব করিলেন, বলিলেন, অহীনের হয়তো দোষ আছে অমল, কিন্তু দোষ তোমারও আছে। ভগ্নিপতির সঙ্গে তোমাদের গুষ্টিরই কোনকালে বনে না। ভগ্নিপতির কাছে মাথা নীচু করতে তোমাদের যেন মাথা কাটা যায়।
অমলও একটু আহত হইল, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হাসিয়া বলিল, মায়েরা দেখছি ছেলের চেয়ে জামাইকে ভালবাসে বেশী। বাসো তাতে হিংসে আমি করছি না। কারণ আমারও তো বিয়ে হবে। কিন্তু আমার ওপর তুমি অবিচার করছ, অহীনের কাছে মাথা নীচু করতে আমার লজ্জা নেই। মাথা নীচু করলেও সে আমাকে দেখতে পায় না। দুঃখ হয় আমার সেইখানে।
হেমাঙ্গিনী চুপ করিয়া রহিলেন। এমন কথার পর অমলকে তিনি দোষ দিতে পারিলেন না।
অমল আবার বলিল, অহীনের একটা ঘোর পরিবর্তন হয়ে গেছে। সঠিক কিছু বুঝতে পারি না, কিন্তু সে অহীন আর নেই। কেমন একটা মিষ্টি মিষ্টি ভাব ছিল অহীনের; এখন সেটা যেন একেবারে মুছে গিয়েছে। এখন তার সব তাতেই বাঁকা ধারালো ঠাট্টা, আর এমন একটা অদ্ভুত হাসি হাসে।
হেমাঙ্গিনী বিস্মিত হইলেন, একটু চিন্তিত হইলেন।
ঠিক এই সময়েই হেমাঙ্গিনীর ডাক পড়িল; রায় মহাশয় নিজে ডাকিতেছিলেন। • একবার তোমার বেয়ানের কাছে যাও দেখিঃ বলে এস, পুরনো দলিলগুলি একবার দেখা দরকার। মানে, আমাদের রায়-বাড়ির মূল বণ্টননামায় চক্ আফজলপুরের কি চৌহদ্দি
এত সব কথা তোমার আমিও বুঝি নে, সুনীতিও বুঝবে না। কি বলছ তাই বল। তোমাদের মামলা মকদ্দমার হাঙ্গামায় আমাদের আহারনিদ্রা সুদ্ধ ঘুচে গেছে।
দলিলের বাক্সগুলো একবার দেখতে হবে। সেগুলো পাঠিয়ে-না থাক, বলে এস, আমিই যাব সন্ধ্যেবেলায়, সব দেখব। রামেশ্বরের ঘরেই যেন বাক্সগুলো বের করিয়ে রাখেন। হ্যাঁ, আরও বলো মঙ্গলবারে মা-সৰ্বরক্ষার পুজো হবে। কালিন্দীর বাঁধের মকদ্দমায় আমাদের একরকম জিতই হয়েছে। বাঁধ দিতে হলে বছর বছর একটা করে খাজনা দিতে হবে কলওয়ালাকে; তার অর্ধেক পাবে চক্রবর্তীরা-ওপারের চরের মালিক হিসাবে, আর অর্ধেক রায়হাটের মালিকরা পাবে। বর্ষা পড়লেই বাঁধ কেটে দিতে হবে।