উমা দ্রুতপদে পাশ কাটিয়া পালাইবার উদ্যোগ করিল। কিন্তু অমল বলিল, বস পোড়ারমুখী বস। একেবারে যেন নাইনটিন্থ সেঞ্চুরির কলাবৌ!
অন্যমনস্ক অহীন্দ্র পর্যন্ত এই অভিনব সজ্জায় সজ্জিতা উমাকে দেখিয়া সমস্ত ভুলিয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার চোখে প্রদীপ্ত মুগ্ধ দৃষ্টি ফুটিয়া উঠিল। উজ্জ্বল মুগ্ধ হাসি হাসিয়া সে আবার বলিল, বস না উমা। ও, তুমি বুঝি ঘোমটা দেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছ? কিন্তু সাঁওতালরা তো কাপড়ের আঁচলে ঘোমটা দেয় না। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।
আলনা হইতে উমার লাল ডুরে গামছাখানা টানিয়া লইয়া অহীন্দ্র বলিল, ওরা গামছার ঘোমটা দেয় এমনি করে। অগ্রসর হইয়া গামছা দিয়া সে উমার মাথায় ঘোমটা টানিয়া দিল।
অমল হাসিয়া বলিল, দাঁড়াও দাঁড়াও, চায়ের ব্যবস্থা করি। তারপর উমিকে আজ সাঁওতালের মেয়ের মত নাচতে হবে।–বলিয়া সে বাহির হইয়া গেল।
উমা ঘাড় হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, অহীন্দ্র অকস্মাৎ অনুভব করিল উমা কাঁদিতেছে। সে সবিস্ময়ে চিবুক ধরিয়া তাহার মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া দেখিল অনর্গল ধারায় উমার চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছে। অহীন্দ্র তাহার অশ্রুসিক্ত মুখখানি বুকে চাপিয়া সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, তুমি কাঁদছ? কি হয়েছে উমা?
উমা জোড় করিয়া চিবুক হইতে অহীন্দ্রের হাত সরাইয়া দিয়া তাহার বুকে মুখ লুকাইয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল। অহীন্দ্র সস্নেহে তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া বলিল, কি হয়েছে, বলবে না আমাকে? এইবার তাহার মনে হইল, সে উমাকে অবহেলা করিয়াছে। অনুতাপের উত্তাপে তাহার আবেগ গাঢ়তর হইয়া উঠিল।
উমা তাহার বুকের মধ্যেই সবেগে মাথা নাড়িল। অহীন্দ্র দুই হাতে তাহার মুখখানি আবার তুলিয়া ধরিল। উমা চোখ বন্ধ করিল, অকস্মাৎ অহীন্দ্র চুমায় চুমায় তাহার মুখখানি ভরিয়া দিয়া তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল।
আকাশে যেন পূর্ণচন্দ্র উঠিয়াছে, জীবনের রিক্ত বালুময় বেলাভূমি জলোচ্ছ্বাসের উল্লাসে আবৃত হইয়া গিয়াছে, তাহা চিরপরিচিত তটভূমির বুকের কাছে অসীম আগ্রহে আবার আগাইয়া আসিতেছে।
***
পরদিন তখনও অন্ধকারের সম্পূর্ণ ঘোর কাটে নাই। উমা এবং অহীন্দ্র সবিস্ময়ে দেখিল, কালো কালো ছায়ার মত সারিবদ্ধ কাহারা সম্মুখের রাস্তা দিয়া চলিয়াছে। সমস্ত রাত্রির মধ্যে উমা ও অহীন্দ্র ঘুমায় নাই। অহীন্দ্র উমাকে বলিয়াছে তাহার অন্তরের সকল চিন্তা সকল বেদনার কথা। উমা নিতান্ত অজ্ঞ পল্লীকন্যা নয়, সে শহরে বড় হইয়াছে, স্কুলে পড়িয়াছে। অহীন্দ্রের কথার প্রতিটি শব্দ না বুঝিলেও, আভাসে সে বুঝিয়াছে অনেক। তাহার তরুণ চিত্ত অহীন্দ্রের গৌরবে কানায় কানায় ভরিয়া উঠিয়াছে।
অহীন্দ্র ওই কালো ছায়ার সারি দেখিয়া সবিস্ময়ে উমাকে প্রশ্ন করিল, কারা বল দেখি?
উমা শঙ্কিত হইয়া বলিল, ডাকাত নয় তো?
অহীন্দ্র উঠিয়া বাহিরের দরজা খুলিয়া বারান্দায় আসিয়া রেলিঙের উপর ঝুঁকিয়া দাঁড়াইল। পুরুষ নারী-শিশু, গরু-মহিষ-ছাগল সারি বাঁধিয়া চলিয়াছে। পুরুষদের কাঁধে ভার, মেয়েদের মাথায় বোঝা, গরু মহিষের পিঠে ছালায় বোঝাই জিনিসপত্র; নীরবে তাহারা পথ অতিক্রম করিয়া চলিয়াছে। কয়খানা গরুর গাড়িও আসিতেছে ধীর মন্থর গতিতে সকলের পিছনে। বোঝাগুলির মধ্যে নিশ্চয় কোথাও মুরগীর পাল আছে, আসন্ন নিশাবসানের আভাসে তাহাদের একটা চীৎকার উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে আর একটা, তাহার পর আরও কয়েকটা।
উমাও অহীন্দ্রের পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, সে অহীন্দ্রকে বলিল, সাঁওতাল?
তাই মনে হচ্ছে। পরক্ষণেই সে ডাকিয়া প্রশ্ন করিল, কে? কারা যাচ্ছ তোমরা?
মেয়েদের কণ্ঠে মৃদু গুঞ্জন ধ্বনিত হইয়া উঠিল, তাহার মধ্যে অহীন্দ্র ও উমা বুঝিল একটা শব্দ, রাঙাবাবু।
কে একজন পুরুষ উত্তর দিল, আমরা গো-মাঝিরা।
মাঝিরা! কোথায় যাচ্ছিস সব?
ইখান থেকে আমরা উঠে যাচ্ছি গো-হু-ই মৌরক্ষীর ধারে লতুন চরাতে!
উঠে যাচ্ছিস তোরা? চলে যাচ্ছিস এখান থেকে? এবারে ব্যাথিত কণ্ঠে উমা প্রশ্ন করিয়া ফেলিল।
হেঁ গো। অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিকভাবে কথাটার উত্তর দিল, অন্য কথা শুনিবার বা উত্তর দিবার জন্য মুহর্তের অপেক্ষাও করিল না।
সবাই চলে যাচ্ছিস তোরা?–সকরুণ মমতায় উমা নিতান্ত শিশুর মতই অর্থহীন প্রশ্ন করিতেছিল। অহীন্দ্র নীরব, তাহার চোখে গভীর একাগ্র নিস্পলক দৃষ্টি, মুখে ক্ষুরের তীক্ষ্ণ স্বল্পপরিসর হাসি। আবার জীবনের সকল উচ্ছ্বাস স্তিমিত হইয়া ভাটায় নামিয়া চলিয়াছে।
উমার প্রশ্নের উত্তরে একজন জবাব দিল, উই বজ্জাত চূড়া মাঝিটো আর ক-ঘর থাকলো গো। উয়ারা সায়েবের সঙ্গ সাঁট করলে, উয়ার কলে খাটবে।–বলিতে বলিতে দলটি অগ্রসর হইয়া চলিয়া গেল। মানুষের ও পশুর পায়ে, গাড়ির চাকায় পথের ধূলা উড়িয়া শূন্যালোক আচ্ছন্ন করিয়া দিল। রহস্যময় প্রত্যুষালোকের মধ্যে ধুলার আবরণখানি যবনিকার মত কালো মানুষগুলির পিছনে প্রসারিত হইয়া ক্রমে তাহাদিগকে বিলুপ্ত করিয়া দিল।
ধীরে ধীরে আঁধার কাটিয়া আসিতেছিল। চরের উপর বয়লারের সিটি বাজিয়া উঠিল। প্রভাতের আলোকে লাল সুরকির পথ, সুদীর্ঘ চিমনি, নূতন মিল হাউস, কুলি-ব্যারাকের বাড়িঘর লইয়া চরখানা একটি নগরের মত ঝলমল করিতেছে।