এ আকস্মিকতায় অহীন্দ্র কিন্তু চমকিয়া উঠিল না, ভ্রূ-কুঞ্চিত করিয়া বিরক্তিভরেই সে অমলের। আপাদমস্তক দৃষ্টি বুলাইয়া লইল, তারপর মৃদু হাসি হাসিয়া বলিল, তুমি!
হাসিয়া অমল বলিল, হ্যাঁ, আমি। কিন্তু তোমার যে দেখি ধ্যানি বুদ্ধের মত অবস্থা।
অহীন্দ্রও একটু হাসিল, তারপর বলিল, ভাবছি ওই চরটার কথা।
ওই চরটাই তোমাকে খেলে দেখছি। ও-সব ভাবনা ছাড়, ওর ব্যবস্থা আমি করে এসেছি। কালেক্টর খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনলেন। ইমিডিয়েটলি এর ব্যবস্থা তিনি করবেন; আর্জেন্ট নোট দিয়ে তিনি আমার সামনে এস.ডি.ও-কে একোয়ারির ভার দিলেন। সাঁওতালদের জমি সম্বন্ধে একটা স্পেশাল আইন আছে। তাতে ওদের জমি বিক্রি হয় না। সে আইন এখানে চালানো যায় কি না দেখবেন।
কথা বলিতে বলিতে অমল অকস্মাৎ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল কলওয়ালা বিমলবাবুর উপর। বলিল, স্কাউণ্ডেলটার সমস্ত কথা আমি বলেছি কালেক্টারকে। দ্যাট পুয়োর ইনোসেন্ট গার্ল-ওই সারী বলে মেয়েটার কথা সূদ্ধ আমি বলেছি কালেক্টারকে।
অহীন্দ্রের মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটিয়া উঠিল। সে হাসি দেখিয়া অমল আহত ও বিরক্ত না হইয়া পারিল, বলিল, হাসছ যে তুমি?
হাসছি ওই লোকটার ওপর তোমার রাগ দেখে।
কেন? রাগের অপরাধটা কি?
অপরাধ নয়, অবিবেচনা। মানে, ও-লোকটা আর নতুন অন্যায় কি করেছে বল? চিরকাল পৃথিবীতে বুদ্ধিমান শক্তিশালীরা দুর্বল নির্বোধের ওপর যে আচরণ করে এসেছে, তার বেশী কিছু করে নি ও বেচারী। সম্রাট বাদশা রাজা দিগ্বিজয়ী থেকে আরম্ভ করে রায়হাটের জমিদার-বংশের পূর্বপুরুষেরা পর্যন্ত সকলেই এই একই আচরণ করে এসেছেন, আপন আপন সাধ্য এবং সামর্থ্য অনুযায়ী। তুমি আমিও সুযোগ পেলে এবং সামর্থ্য থাকলে তাই করতাম; হয়তো ভবিষ্যতে করবও।
অমল বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেল, শুধু বিস্ময় নয়, অন্তরে অন্তরে সে একটা তীব্র জ্বালাও অনুভব করিল। সে ঈষৎ উষ্মভরেই প্রশ্ন করিল, হোয়াট ডু ইউ মীন?
হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, বিশ্বচরাচরে আদিকাল থেকে যা ঘটে, ওই চরেও ঠিক তাই ঘটল বন্ধু। সাঁওতালগুলো ওই ভাবে বঞ্চিত হতেই বাধ্য, ওই মেয়েটার ওই দুর্দশাই স্বাভাবিক। চরটা এবং তোমার মধ্যে টাইম অ্যাণ্ড স্পেসের ডাইমেশন বাড়িয়ে নাও না, দেখবে চরটা বেমালুম পৃথিবীর সঙ্গে মিশে গেছে, পার্থক্য নেই।
অমল এবার স্তব্ধ হইয়া গেল। অহীন্দ্রের কথা এবং তাহার কণ্ঠস্বরের সকরুণ আন্তরিকতা তাহাকে প্রতিবেশীর শোকের মত স্পর্শ করিল, আচ্ছন্ন করিল। অর্ধস্ফূট হাসিটুকু অহীন্দ্রের মুখে লাগিয়াই রহিল, সেই অবস্থাতেই সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হইয়া গেল।
অনেকক্ষণ পর অমল জোর করিয়া চিন্তাটাকে ঝাড়িয়া ফেলিয়া বলিল, হ্যাং ইয়োর বিশ্বপ্রেম। ওঠ এখন, সন্ধ্যে হয়ে গেল।
অন্যমনস্কভাবে অহীন্দ্র বলিল, অ্যাঁ?
ওঠ ওঠ, সন্ধ্যে হয়ে গেল। যত সব উদ্ভট চিন্তা! চল, এখন বাড়ি চল। আচ্ছন্ন স্বপ্নাতুরের মতই অহীন্দ্র উঠিল এবং অমলের সঙ্গে রায়-বাড়ির পথ ধরিল। চলিতে চলিতে অমল বলিল, দিস ইজ ব্যাড, অহীন
অহীন্দ্র কোন উত্তর দিল না।
অমল তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল, ভো-ভো চিন্তাকুল মনুষ্য!
অ্যাঁ!
আরে রাম রাম, তুমি যে শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যাবে।
অহীন্দ্র এ কথার কোন জবাব দিল না। তাহার কানে কোন কথাই যেন প্রবেশ করিতেছে না, শব্দ কর্ণপটহে আঘাত করিলেও অর্থ মন পর্যন্ত পৌঁছিতে পারিতেছে না। তাহার মনের অবস্থা ঠিক যেন ভাটার সমুদ্রের মত; তাহার পরিচিত পৃথিবীর সুন্দর শ্যামল তটভূমি ক্রমশ যেন মিলাইয়া একাকার হইয়া যাইতেছে দূর হইতে দূরান্তরের অস্পষ্টতায় অপরিচয়ের মধ্যে। অথচ কোন গোপন অতল পথে কেমন করিয়া যে। জীবনের সকল ঊর্ধ্বমূখী জলোচ্ছাস নিন্মমুখে নিঃশেষিত হইয়া যাইতেছে, সে রহস্য তাহার অজ্ঞাত।
.
উমা তখন উত্তেজিত হইয়া একটা ড্রেসিং টেবিলের কোণ ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। বেশভূষা প্রসাধন লইয়া প্রচণ্ড একটা ঝড় বহিয়া গিয়াছে ইহারই মধ্যে। সে কোনমতেই বেশভূষার পরিবর্তন করিবে না, যেমনই আছে তেমনি থাকিবে! হেমাঙ্গিনী মেয়ের উপর ভীষণ চটিয়া গিয়া হাল ছাড়িয়া দিয়াছেন, বলিয়াছেন, ‘ঘি দিয়ে ভাজ নিমের পাত, নিম না ছাড়েন আপন জাত’, তোর দোষ কি বল, তোদের বংশের ধারাই এই!
উমা কোন উত্তর করে নাই, কিন্তু তাহার কালো বড় চোখ দুইটি হইয়া উঠিয়াছিল বিদ্যুতালোকিত মেঘের মত। হেমাঙ্গিনী সে-দিকে ভ্রুক্ষেপ না করিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার ভাজ-উমার মামীমা তাঁহাকে শান্ত করিয়া মৃদুস্বরে বলিয়াছেন, ঠাকুরঝি, ও-সব হচ্ছে আজকালকার ফ্যাশান। তুমি রাগ করছ কেন?
উমা তখন হইতেই ড্রেসিং টেবিলের কোণ ধরিয়া তেমনি ভাবেই দাঁড়াইয়া আছে। সেই সাঁওতালদের মত সিঁথি বিলুপ্ত করিয়া চুল বাঁধা, খোঁপায় গাঁদাফুলের মালা, পরনে মোটা সূতার সাঁওতালী শাড়ি; এক নজরে উমাকে চিনিবার পর্যন্ত উপায় নাই। অকস্মাৎ উমা চকিত হইয়া সরিয়া দাঁড়াইল, আয়নার মধ্যে ছায়া পড়িল অহীন্দ্র ও অমলের। অহীন্দ্র ও অমল ঘরে প্রবেশ করিতেই উমা বিব্রত হইয়া পড়িল, সাঁওতালী শাড়িটা অবগুণ্ঠন দিবার মত পর্যাপ্ত দীর্ঘ নয়। অমল হাসিয়া বলিল, লেট মি ইনট্রোডিউস, উমনী টেকরুন অ্যাণ্ড রাঙাবাবু।