অমল বাড়ি নাই, ইন্দ্র রায় তাহাকে সদরে পাঠাইয়াছেন। ওই চরের ব্যাপার লইয়াই সে খোদ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট এক দরবার করিতে গিয়াছে। চক্রবর্তী-বাড়ির প্রতিনিধি হইয়াই সে গিয়াছে। কলওয়ালার অত্যাচারে চরের প্রজা উৎখাত হইয়া যাইতেছে, জোরপূর্বক নদীতে বাঁধ দিয়া পাম্প করিয়া জল তোলায় জলাভাবে চাষ নষ্ট হইয়া যাইতেছে; এমন কি গরীবদের গার্হস্থ্যজীবন পর্যন্ত বিপর্যস্ত হইয়া গেল। যাওয়া উচিত ছিল অহীন্দ্রের। কিন্তু বিবাহের আচার-আচরণগুলির জন্য তাহার যাওয়া চলে না বলিয়াই অমল গিয়াছে চক্রবর্তী-বাড়ির প্রতিনিধিরূপে। শ্বশুর-জামাই দুইজনে উপরের ঘরে বসিয়া আলোচনা করিতেছে; আলোচনা অবশ্য একতরফা। রায় একাই কথা বলিতেছিলেন। অহীন্দ্রকে সমস্ত কথা ভাল করিয়া বুঝাইতেছিলেন।
অহীন্দ্র নীরবে বসিয়া শুনিতেছিলেন। হেমাঙ্গিনী জলখাবার আনিয়া রায়কে বলিলেন, না বাপু তুমি কি অদ্ভুত মানুষ, জমিদারি, মকদ্দমা, দাঙ্গাহাঙ্গামা এই ছাড়া কি আর কথা নাই তোমাদের? অমলকে তো পাঠিয়ে দিলে সদরে, এইবার অহীনকে পার তো হাইকোর্টে পাঠাও?
রায় হাসিয়া বলিলেন, জান, আকবর-শা বাদশা বারো বছর বয়সে হিন্দুস্থানের বাদশা হয়েছিলেন। জমিদারের ছেলে জমিদারির কাজ না শিখলে হবে কেন? জেলার হাকিমদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় রাখতে হবে, বিষয়-সম্পত্তির কোথায় কি আছে জানতে হবে; তবে তো! আর মোটামুটি আইন-কানুন-এগুলোও জেনে রাখতে হবে। আর দাঙ্গা-হাঙ্গামা-এগুলোও একটু-আধটু শিখতে হবে বৈকি। জান তো, ‘মাটি বাপের নয়, মাটি দাপের’? একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া মৃদু হাসিয়া রায় আবার বলিলেন, দাঙ্গাই বল, আর হাঙ্গামাই বল, আসলে হল যুদ্ধ! রাজায় রাজায় হলেই হয় যুদ্ধ, আর জমিদারে জমিদারে হলেই হয় দাঙ্গা। আসলে হলাম আমরা রাজা। ছোট অবশ্য-গরুড় আর চামচিকে যেমন আর কি! বলিয়া তিনি হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। তারপর উঠিয়া বলিলেন, তা হলে তুমি বস বাবা। আমি একবার দেখি, সেরেস্তার কাজ অনেক বাকি পড়ে আছে। অমল এই বেলাতেই এসে পড়বে।
অমল ফিরিল অপরাহ্নে-অপরাহ্নের প্রায় শেষভাগে। অহীন্দ্র তখন বেড়াইতে বাহির হইয়া গিয়াছে। স্বভাবধর্ম অনুযায়ী অমল শোরগোল তুলিয়া ফেলিল। সে উমাকে এক নূতন নামে চীৎকার করিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিল, উমনী! উমনী! এই উমনী!
হেমাঙ্গিনী ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, ও কি? উমনী আবার কি?
হাসিয়া অমল বলিল, উমার নূতন নাম বের করেছি আমি।
দাদার সাড়া পাইয়া উমা ঈষৎ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সে হাসিমুখে আসিয়া অমলের কাছে দাঁড়াইল, অমল বলিল, তোর নূতন নাম দিয়েছি উমনী; পছন্দ কি না, বল? সে আপনার সুটকেসটি খুলিতে বসিল।
উমা কোন জবাব দিল না, হাসিতেছিল, হাসিতেই থাকিল। অমলকে পাইয়া তাহার মন যেন অনেকটা হাল্কা হইয়া উঠিয়াছে।
অমল সুটকেসের তলায় চাবিটা পরাইয়া বলিল, বল বল, শিগগির বল্- yes or no?
উমা এবার বলিল, খারাপ নাম আবার কেউ পছন্দ করে নাকি?
ও সব আমি বুঝি না। Say, yes or no।
ঘাড় নাড়িয়া উমা বলিল, No।
No! আচ্ছা, তবে থাকল, পেলি না তুই। অমল সুটকেস হইতে হাত সরাইয়া লইল।
উমা উৎসুক হইয়া প্রশ্ন করিল, কি?
সে জেনে তোর দরকার কি?
অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়া উমা এবার বলিল, না না না, তবে no নয়, no নয়। Yes-yes।
অমল সুটকেস খুলিয়া বাহির করিল-সাঁওতাল-তাঁতীর বোনা মোটা সুতার একখানি সাঁওতালী কাপড়। সাদা ধবধবে দুধের মত জমি, প্রান্তে লাল কস্তার চওড়া সাঁওতালী মইপাড় শাড়ি। দেখিয়া উমার চোখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। অমল শাড়িখানি উমার হাতে দিয়া বলিল, Queen of the Santhals- মহামহিমান্বিত উমনী ঠাকরুণ। যা পরে আয়, এক্ষুণি পরে আয়, দেখি কেমন মানায়। যা।
উমা গেল, কিন্তু উৎসাহিত চঞ্চল গমনে নয়; মন্থর গতিতেই চলিয়া গেল।
অমল হাসিয়া বলিল, তিন দিনে দেখছি, উমনীর তেত্রিশ বছর বয়স বেড়ে গেছে। মেয়েটার লজ্জা এসে গেছে।
হেমাঙ্গিনী একটু ধমক দিয়া বলিলেন, তোর জ্ঞানবুদ্ধি কোন কালে হবে না অমল। নে, মুখ-হাত ধুয়ে নে। অহীন বেড়াতে গেছে, তুই বরং একটু বেরিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে আয়।
উত্তম কথা। উমনী ঠেক্রুণকেও তা হলে সঙ্গে নিয়ে যাব। বলিয়াই সে হাঁকিতে আরম্ভ করিল, উমনী! উমনী!
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, না। গাঁয়ে শ্বশুরবাড়ি; ও সব তোমার খেয়াল-খুশি মত হবে না। শ্বশুরবাড়ির কথা ছেড়ে দিয়েও তোমার বাপই শুনলে রাগ করবেন।
উমা সাঁওতালী শাড়ি পরিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। অদ্ভুত রকম দেখাইতেছিল উমাকে। হেমাঙ্গিনী দেখিয়া হাসিয়া ফেলিলেন, বলিলেন, যা যা, ছেড়ে ফেল্ গে। অমল বলিল, না না না, এক কাজ কর উমনী, সাঁওতালদের মত চুলটা বাঁধ দেখি, কতকগুলো গাঁদাফুল পর খোঁপায়। একটা ফোটো তুলে নিই তা হলে।
ফোটোর নামে উমা আবার একটু দীপ্ত হইয়া উঠিল।
***
অমল আসিয়া উপস্থিত হইল কালিন্দীর ঘাটে। সে ঠিক জানে অহীন্দ্রকে কোথায় পাওয়া যাইবে। ঘাটের পাশে অল্প একটু দূরে একটা ভাঙনের মাথায় ঘাসের উপর অহীন্দ্র বসিয়া ছিল। ভাঙনটার ঠিক সম্মুখে ও-পারে চরের উপর সাঁওতাল-পল্লীটি দেখা যাইতেছে। পল্লীটি স্তব্ধ। চরের ও-পাশে কারখানার হিন্দুস্থানী শ্রমিক-পল্লীতে একটা ঢোল বাজিতেছে। পচুই মদের দোকান হইতে ভাসিয়া আসিতেছে উজ্জ্বল কলরব। অহীন্দ্র স্থাণুর মত বসিয়া ও-পারের দিকে চাহিয়া ছিল। অমল পা টিপিয়া আসিয়া তাহার পিছনে দাঁড়াইল। কিন্তু তাহাতেও অহীন্দ্রের একাগ্রতা ক্ষুণ্ণ হইল না। অমল বিস্মিত হইয়া সশব্দে অগ্রসর হইয়া অহীন্দ্রের পাশে বসিয়া কহিল, ব্যাপার কি বল তো? ধ্যান করছ নাকি?