সুনীতা হাসিমুখে উঠিলেন, বলিলেন, আহা দিদি, মানুষের জীবন গেলে তো আর ফেরে না। সারা সকালটা আমার বুকে কে যেন পাষাণ চাপিয়ে দিয়েছিল।
নীচে ইন্দ্র রায়ের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কই রে, উমা কোথায় গেলি? তোর শ্বশুর কি করছেন রে?
উমার অপেক্ষা না করিয়াই তিনি উপরে উঠিয়া আসিয়া রামেশ্বরের ঘরে প্রবেশ করিলেন। কয়েক মুহূর্ত পরেই গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চ হাসির সঙ্গে শোনা গেল, ফৌজদারী মামলা করে কলওলা আমাদের জব্দ করবে! বলিয়া অবজ্ঞাপূর্ণ কৌতুকে উচ্ছ্বসিত হাসি-হা-হা-হা-হা।
সে হাসির শব্দ নীচে বাগদী লাঠিয়ালদের কলরব মিশিয়া সমস্ত মহলটা যেন গমগম করিয়া উঠিল। ভাণ্ডারের দুয়ারে তাহারা জলখাবার লইতে আসিয়া গোলমাল করিতেছিল। মানদা রেলিঙের উপর বুক দিয়া ঝুঁকিয়া বলিল, খুব তো চেঁচাচ্ছিস সব! সেই বিভীষণ মজুমদারের একটা ঠ্যাং ভেঙে দিয়ে আসতিস, তবে বুঝতাম। কিংবা একপাটি দাঁত
বলিতে বলিতে সে সসম্ভ্রমে সঙ্কুচিত হইয়া চুপ হইয়া গেল।
ভারি গলায় কণ্ঠনালী পরিস্কার করিয়া লওয়ার উচ্চ গম্ভীর শব্দ জানাইয়া দিল রায় বাহির হইয়া আসিতেছেন। রায় ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া ডাকিলেন, উমা!
মানদা ত্রস্তপদে গিয়া উমাকে ডাকিয়া দিল। উমা আসিয়া বাপের সম্মুখে দাঁড়াইতেই সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইয়া রায় বলিলেন, খুব যে বউ সেজে গেছিস মা! তোকে একেবারে দেখবারই জো নেই।-বলিয়া উমার মুখের দিকে চাহিয়া তিনি যুগপৎ বিস্মিত এবং শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। উমার মুখ নিশান্তের জ্যোৎস্নার মত সকরুণ পাণ্ডুর। পরমুহূর্তেই মনে পড়িল, কাল রাত্রে ফুলশয্যা গিয়াছে। হাসিয়া বলিলেন, তোর শাশুড়ীকে বল্ মা, রামেশ্বরের স্নান-আহ্নিকের ব্যবস্থা করে দিন। দুর্বল শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তোরাও স্নান-টান করে সব বিশ্রাম ক।
উমাকে রামেশ্বরের পরিচর্যার জন্য বলিবেন সঙ্কল্প করিয়া ডাকিয়াছিলেন। কিন্তু উমার এমন ক্লান্ত ভঙ্গি দেখিয়া সুনীতিকে ডাকিবার জন্য বলিলেন। গত রাত্রির রামেশ্বর আজ আর নাই, রায়ের উচ্চ হাস্য, উল্লাস তাঁহাকে স্পর্শও করিতে পারে নাই। রোগ যেন আজ বাড়িয়া গিয়াছে।
.
রায় সত্য দেখিয়াও ভ্রম করিলেন। উমার মুখ সত্যই সকরুণ পাণ্ডুর, কিন্তু সে ফুলশয্যার রজনীর আনন্দে অবসাদে নয়। গোপন অন্তরে নিরুদ্ধ সুগভীর অভিমান ও দুঃখের দাহে তাহার মুখের লাবণ্যের সজীবতা এমন শুকাইয়া গিয়াছে। জীবনের প্রথম মিলন-বাসরে অহীন্দ্রের মধ্যে সে পরম বাঞ্ছিত জনকে খুঁজিয়া পায় নাই, এমন কি এতদিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু-অহীন্দ্রেরও দেখা পায় নাই। স্তব্ধ উদাসীন, এ যেন অস্বাভাবিক অপরিচিত এক অহীন্দ্র! দৃষ্টিপাত অবরোধ করিয়া দাঁড়াইয়াও তাহার দৃষ্টিতে পড়া যায় না। সকাল হইতে এতটা বেলা পর্যন্ত বাহিরের বারান্দায় সে পায়চারি করিতেছে, কত বার তাহার দৃষ্টির সাথে তাহার দৃষ্টি মিলিয়াছে, উমার দৃষ্টি সুস্পষ্ট অভিমানের বার্তা জানিয়াছে, কিন্তু অহীন্দ্রের দৃষ্টি যেন বধির মূক হইয়া গিয়াছে; কোন বার্তা সে–দৃষ্টির গোচরে আসে নাই, কোনও উত্তরও দিতে পারে নাই। মানদা অদূরে দাঁড়াইয় ছিল, রায় নীচে চলিয়া যাইতেই বলিল, চলুন বৌদিদি, চান করবেন চলুন। মুখ আপনার বড্ড শুকিয়ে গিয়েছে।
৩১-৩৫. হেমাঙ্গিনীও ভুল করিলেন
শুধু ইন্দ্র রায়ই নয়, হেমাঙ্গিনীও ভুল করিলেন।
ফুলশয্যার দিন-দুই পরেই বর ও কন্যার জোড়ে কন্যার পিত্রালয়ে আসবার বিধি আছে, ‘অষ্টমঙ্গলা’র যাহা কিছু আচার-পদ্ধতি সবই কন্যার পিত্রালয়েই পালনীয়; সূতরাং অহীন্দ্র ও উমা-রায় বাড়িতে আসিল। হেমাঙ্গিণী ও বাড়িতে আসা-যাওয়া করিলেও উমাকে ভাল করিয়া দেখিবার সুযোগ পান নাই, সুযোগ তিনি ইচ্ছা করিয়াই গ্রহণ করেন নাই। হাজার হইলেও তিনি মেয়ের মা। নদীকূলের বাসিন্দার মত, নিন্দারূপ বন্যার ভয় যে মেয়ের মায়ের অহরহ। কঠোরভাবে তিনি কন্যার জননীর কর্তব্য পালন করিয়াছেন, উমার কাছে গিয়া একদিন বসেন নাই পর্যন্ত। মানুষের মনকে বিশ্বাস নাই, কে হয়তো এখনই বলিয়া বসিবে যে, মেয়েকে তিনি কোন গোপন পরামর্শ দিতে আসিয়াছেন।
আপন গৃহে কন্যাকে পাইয়া কন্যার মুখ দেখিয়া তিনি প্রথমটায় শিহরিয়া উঠিলেন, কিন্তু পরক্ষণেই হাসিলেন, স্বামীর কথাটা তাঁহার মনে পড়িয়া গেল। রায় সেদিন বাড়ি আসিয়াই হেমাঙ্গিনীকে কথাটা বলিয়াছিলেন। হেমাঙ্গিনী হাসিয়া বলিয়াছিলেন, ওদের তো আমাদের মত অজানা-অচেনাও নয়, পনেরো বছরের বর, দশ বছরের কনেও নয়।
রায় হাসিয়া বলিয়াছিলেন, তা বটে।
হেমাঙ্গিনী মৃদু হাসিয়া, উমার কপালে খসিয়া-পড়া চুলগুলিকে আঙুলের ডগা দিয়া তুলিয়া দিলেন, বলিলেন, স্নান করে খেয়ে-দেয়ে বেশ ভাল করে একটু ঘুমো দেখি।
উমা নিতান্ত ছোট মেয়ে নয়, সে মায়ের মৃদু হাসি ও কথাগুলির অর্থ দুইই বেশ বুঝিতে পারিল। দুঃখে অভিমানে তাঁহার চোখ ফাটিয়া জল আসিতেছিল কিন্তু প্রাণপণে আপনাকে সংহত করিয়া সে-আবেগ সে রোধ করিল। মাথা নীচু করিয়া ধীরে ধীরে সে উঠিয়া গেল। মা মনে করিলেন, কন্যার লজ্জা। তিনি আরও একটু হাসিয়া অহীন্দ্রকে জলখাবার দিতে উঠিলেন। বিবাহ উপলক্ষে সমাগতা তরুণী কুটুম্বিনীর দল উমার সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া গিয়াছিল, উমার আজ তাহাদের মধ্যেই থাকিবার কথা। ভাঁড়ারের দিকে চলিতে চলিতে হেমাঙ্গিনী আবার হাসিলেন।