আমাদের কাছে অনেকে কালিন্দী উপন্যাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। কালিন্দী উপন্যাস – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়এর লেখা একটি অসাধারণ কল্পকাহিনীর বই। আপনারা যদি কালিন্দী উপন্যাসের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সঠিক জানতে চান তবে অবশ্যই উপন্যাসটি পড়তে হবে। তবে চলুন আর দেড়ি না করে উপন্যাসটি পড়ে নেয়।
কালিন্দী বইয়ের বিবরণঃ
- বইয়ের নামঃ কালিন্দী
- লেখকের নামঃ তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১-৫. নদীর ওপারে একটা চর
কালিন্দী– উপন্যাস– তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
নদীর ওপারে একটা চর দেখা দিয়েছে।
রায়হাট গ্রামের প্রান্তেই ব্রাহ্মণী নদী–ব্রাহ্মণীর স্থানীয় নাম কালিন্দী, লোকে বলে কালী নদী; এই কালী নদীর ওপারে চর জাগিয়াছে। এখন যেখানে চর উঠিয়াছে পূর্বে ওইখানেই ছিল কালী নদীর গর্ভভূমি। এখন কালী রায়হাটের একাংশ গ্রাস করিয়া গ্রামের কোলে কোলে বহিয়া চলিয়াছে। গ্রামের লোককে এখন বিশ হাত উঁচু ভাঙন ভাঙ্গিয়া নদীগর্ভে নামিতে হয়।
ওই চরটা লইয়া বিবাদ বাধিয়া উঠিল। রায়হাট প্রাচীন গ্রাম। এখানকার প্রাচীন জমিদার-বংশ রায়েরা শাখা-প্রশাখায় বহুধা বিভক্ত। এই বহুবিভক্ত রায়-বংশের প্রায় সকল শরিকই চরটার স্বামীত্ব লাভ করিবার নিমিত্ত এক হাতে লাঠি ও অপর হাতে কাগজ লইয়া অগ্রসর হইলেন। ইঁহাদের মধ্যে আবার মাথা গলাইয়া আসিয়া প্রবেশ করিল জন দুয়েক মহাজন এবং জন কয়েক চাষীপ্রজা। সমস্ত লইয়া বিবদমান পক্ষের সংখ্যা এক শত পনেরোয় গিয়া দাঁড়াইয়াছে, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিরোধী। জমিদারগণের প্রত্যেকের দাবি–চর তাহার সীমানায় উঠিয়াছে, সুতরাং সেটা তাহারই খাস-দখলে প্রাপ্য। মহাজন দুইজনের প্রত্যেকের দাবি, তাহার নিকট আবদ্ধীয় জমির সংলগ্ন হইয়া উঠিয়াছে, সুতরাং চর তাঁহার নিকট আবদ্ধীয় সম্পত্তি বলিয়া গণ্য হওয়া উচিত এবং নাকি তাহাই হইতে হইবে। প্রজা কয়েক জনের দাবি–কালীর গ্রাসে এপারে তাহাদের জমি গিয়াছে, সুতরাং ওপারে যে ক্ষতিপূরণ কালী দিয়াছে সে প্রাপ্য তাহাদের।
রায়-বংশের বর্তমানে এক শত পাঁচ জন শরিক, বাকী খাজনার মকদ্দমায় জমিদারপক্ষীয় গণের নাম লিখিতে, তিন পৃষ্ঠা কাগজ পূর্ণ হইয়া যায়। ইহাদের মধ্যে যোগ দিয়াছেন এক শত দুই জন। বাকী তিন পক্ষের মধ্যে এক পক্ষের মালিক নিতান্তই সঙ্গতিহীন নাবালক। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পক্ষ কিন্তু এখানকার বহুকালের দুইটি বিবদমান পক্ষ। এক পক্ষ রায়-বংশের দৌহিত্র বংশ, অপর পক্ষ রায়-বংশেরই সর্বাপেক্ষা ধুরন্ধর ব্যক্তি কূট-কৌশলী ইন্দ্র রায়। ইন্দ্র রায়ের হাত গরুড়ের তীক্ষ্ণ নখরের মত প্রসারিত হইলে কখনও শূন্য মুষ্টিতে ফেরে না, ভূখণ্ডও বোধ করি উপড়াইয়া উঠিয়া আসে। এই ইন্দ্র রায়ের অপেক্ষাতেই বিবদমান পক্ষ সকলেরই উদ্যত হস্ত এখনও স্তব্ধ হইয়া আছে, অন্যথায় এতদিন একটা বিপর্যয় ঘটিয়া যাইত।
অপর পক্ষ–ইন্দ্র রায়ের বংশানুক্রমিক প্রতিপক্ষ রামেশ্বর চক্রবর্তী। তিনিও এক কালে ইন্দ্র রায়ের সমকক্ষ ব্যক্তি ছিলেন; কূট বুদ্ধি অপেক্ষা ব্যক্তিত্ব ছিল তাহার বড়; দাম্ভিকতার প্রতিমূর্তি। ইন্দ্র রায়ের সহিত দ্বন্দ্বে ইন্দ্র রায়কেই অস্ত্রস্বরূপ ব্যবহার করিতেন; প্রতি ক্ষেত্রে তিনি সাক্ষী মানিতেন ইন্দ্র রায়কে। ইন্দ্র রায় মিথ্যা বলিলে তিনি হাসিয়া তাহার দাবি প্রত্যাহার করিয়া বলিতেন, তোমার সাক্ষী দেওয়ার ফী দিলাম ইন্দ্র। মিছেই খরচ করে সাক্ষীদের তুমি জুতো কিনে দিলে। বাড়ি ফিরিয়া তিনি গ্রামে বড় একটা খাওয়া-দাওয়া জুড়িয়া দিতেন।
কিন্তু যে কালের গতিতে যদুপতি যান, তাহার মথুরাপুরীও গৌরব হারায়, সেই কালের প্রভাবেই বোধ করি সে রামেশ্বর আজ আর নাই। তিনি নাকি দৃষ্টিহীন হইয়া অন্ধকার ঘরে বিছানায় পড়িয়া আছেন ভূমিশায়ী জীর্ণ জয়স্তম্ভের মত। চোখে নাকি আলো একেবারে সহ্য হয় না, আর মস্তিষ্কও নাকি বিকৃত হইয়া গিয়াছে। সম্পত্তি পরিচালনা করে প্রাচীন নায়েব যোগেশ মজুমদার; যোগেশ মজুমদারের অন্তরালে আছেন শান্ত বিষাদপ্রতিমার মত একটি নারীমূর্তি রামেশ্বরের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী সুনীতি দেবী। দুইটি পুত্র-বড়টির বয়স আঠারো, ছোটটি সবে পনেরোয় পা দিয়াছে; সম্প্রতি মজুমদার সুনীতি দেবীকে অনেক বলিয়া কহিয়া বড়টিকে পড়া ছাড়াইয়া বিষয়কর্মে লিপ্ত করিয়াছেন। অবশ্য লেখাপড়াতেও তাহার অনুরাগ বলিয়া কিছু ছিল না। এই বিবাদ আরম্ভ হইবার পূর্ব হইতেই মজুমদার এবং রামেশ্বরের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহীন্দ্র এখানে নাই–তাহারা দূর মহালে গিয়াছে মহাল পরিদর্শনে। লোকে বুঝিল, হয় ইন্দ্র রায় প্রতিদ্বন্দ্বীর অপেক্ষায় আছেন, নয় সুযোগের প্রতীক্ষা করিতেছেন, উপযুক্ত সময়ে ছোঁ মারিয়া বসিবেন।
চাষী প্রজারা এতটা বোঝে নাই, তাহারা সেদিন আসিয়া ইন্দ্র রায়কেই ধরিয়া বসিল, হুজুর, আপনি একটা বিচার করে দ্যান।
অতি মৃদু হাস্যের সহিত অল্প একটু ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া তিনি বলিলেন, কিসের রে?–যেন তিনি কিছুই জানেন না–কার সঙ্গে ঝগড়া হল তোদের?