গাড়ি এসে থামল আরোগ্য-নিকেতনের সামনে। কে বসে আছে? শশী? আর ওটা? বিনয়? নবগ্রামের বি-কে স্টোর্সের মালিক! কাল ও আসবে বলেছিল বটে।
শশী তাঁকে দেখবামাত্র উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।—আজ আমি ছাড়ব না, পায়ের ধুলো নোব। জয় গুরুদেব। অখণ্ডমণ্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরং-তৎপদং দৰ্শিতং যেন তস্মৈ শ্ৰীগুরুবে নমঃ।
রামহরির উইলে মশায় তার শেষ স্ত্রীকে পাঁচ বিঘে জমি দিতে রামহরিকে রাজি করিয়েছেন। রামহরি শশীকেও পনেরটা টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। মশায় তাকে বাঁচিয়েছেন তিনি তাঁর পূর্বজন্মের বাপ-তার আজ্ঞা সে কি লঙ্ন করতে পারে? রামহরিরা বিচিত্র। ওরা সারা জীবনটাই পাপ করে যায়, কোনো নীতিধৰ্মই মানে না, কিন্তু দুটি একটি নীতি যা মানে তা কোনো কালে লঙ্ঘন করে না।
–তারপর? বিনয়কুমার, তোমার সংবাদ? বিনয় চুপ করেই বসে আছে। মুখর মানুষ সে। জীবনের সাফল্যের উল্লাস অহরহই যেন ভেসে বেড়ায় দুরন্ত হাওয়ার মত। দুরন্ত কিন্তু উত্তপ্ত হাওয়া নয় বিনয়; সার্থক ব্যবসাদার মানুষ, বর্ষার জলভরা মেঘের স্পর্শে সজল এবং শীতল। বিনয় মিষ্টভাষী মানুষ।
বিনয় বললে—আমার মশায়, অনেক কথা। সংসারে মানুষ দু রকম, এক কমবক্তা আর এক উদ্বক্তা। আমি একেই উক্তা, তার উপর অনেক কথা। শশী ডাক্তারের হোক, তারপর বলছি আমি।
–কথা অনেক থাকলে কাল আসিস বিনয়। আজ আমার মনটা ভাল নয়।
–কী হল?
–বোস। আসছি আমি।
বেরিয়ে এলেন মশায়। অতসীর ছেলেটি কেমন আছে? ছেলেটির সেই ফুটফুটে মুখখানি চোখের উপর ভাসছে। তার আজকের রোগক্লিষ্ট অর্থ-চেতনাহীন বিহ্বল দৃষ্টি মনে পড়ছে। তার চিবুক থেকে কৰ্ণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত রক্তরাঙা স্ফীতিটাকালবৈশাখীর মেঘ কতটা ছড়াল? ঝড় কতটা বাড়ল?
বেরিয়ে এসেও থমকে দাঁড়ালেন। যাবেন তিনি? উচিত হবে?
কে বেরিয়ে আসছে? প্রদ্যোত ডাক্তারের সেই বন্ধুটি নয়? হ্যাঁ, সেই তো!
মশায়ই আজ নমস্কার করলেন-নমস্কার। আবার ওখানে গিয়েছিলেন কি?
–নমস্কার। হ্যাঁ, ছেলেটির রক্ত নিলাম, পরীক্ষা করে দেখব।
–কিন্তু সে তো সদরে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করবেন। ফল অন্তত কাল না হলে এখানে জানতে পারবেন না।
–হ্যাঁ। কিন্তু তা ছাড়া তো উপায় নাই। তবে পেনিসিলিন দেওয়া হয়েছে। মনে হচ্ছেস্ট্রেপ্টোককাস ইনফেকশন হয়েছে। হবেও তাই। দেখি।
—স্ট্রেপ্টোককাস ইনফেকশন?
–হ্যাঁ। আপনারা যাকে বলেন সান্নিপাতিক। গলার ভিতরে ঘা দাঁড়াবে ছোট ছোট মটরের মত।
—খানিকটা ডাক্তারি পড়েছিলাম-বাড়িতে। স্ট্রেপ্টোককাস শুনেছি। গলায় ঘা দেখেছি। অবিশ্যি সাধারণ লোকে ওকে সান্নিপাতিক বলে। আসলে সান্নিপাতিক ভিন্ন ব্যাপার। সে খুব কঠিন। কিন্তু–
–কিন্তু কী? আপনার মতে কী?
–জ্বর এখন কত দেখে এলেন?
–একশো তিন। কিছু কম। পেনিসিলিন পড়েছে, পেনিসিলিনের জন্যেও জ্বর একটু বাড়বে।
–না। এ জ্বর ওর রোজই বাড়ছে ডাক্তারবাবু। আমি পাস করা ডাক্তার নই, তবে চিকিৎসা অনেক করেছি। এর মেয়াদ চব্বিশ ঘণ্টা। একটা প্রচণ্ড বিষ ঢুকেছে রক্তে। ফুলো কতটা
বেড়েছে?
অরুণেন্দ্র ডাক্তার অভিভূত হয়ে গিয়েছিল এই বৃদ্ধের কথার আন্তরিকতায়। জ্ঞানের, অনুভূতির আভাসও সে অনুভব করছিল। মনে মনে চিন্তা করতে করতেই অরুণেন্দ্ৰ উত্তর দিলে অনেকটা বেড়েছে। বাড়ছে। আমাদের ধারণা স্ট্রেপ্টোককাস ইনফেকশন হয়েছে খুব বেশি। বিকেল পর্যন্ত গলায় ঘা দেখা দেবে। আপনি বলছেন–
—আমি বলছি—আমার আমলের চিকিৎসায় এ রোগের আক্রমণ যা প্রবল তাতে সারবার। নয় ডাক্তারবাবু। আমি পারি না। আপনারা ভাগ্যবান—এ আমলে অদ্ভুত ওষুধের সাহায্য পেয়েছেন। যা করবার সময়ে করুন। ঝড়ের মতন আসছে রোগের বৃদ্ধি। টেকাতে পারলেন তো থাকল, নইলে—। আমার এই কথাটা বিশ্বাস করুন।
—আমি বিশ্বাস করি মশায়। আমি বিশ্বাস করি। প্রদ্যোত অবশ্য একটু উগ্র। ছেলেও ও ভাল ছিল আমার চেয়ে। আমি ওকে গিয়ে বলছি।
সাইকেল চেপে সে চলে গেল।
কী হল গুরুদেব? আবার কী হল প্রদ্যোতের সঙ্গে? মশায়ের ঘন পাকা ভুরু দুটি কুঞ্চিত হয়ে উঠল। শশী? এখনও রয়েছি? আজ বাড়ি যা। আজ বাড়ি যা।
—বাড়ি যাব; এই বিনয়ের সঙ্গে যাব।
বিনয় যাবে পরে। তুই যা। তোর কাজ তো হয়ে গিয়েছে।
বিনয় হেসে বললে—শশী ডাক্তার যাবে কী? সঙ্গ নইলে যেতে পারবে না। একা পথ হাঁটলেই ওর মা পাশে পাশে ফিরবে।
—কে?
—ওর মা গো! মরেও বেচারি ছেলের মায়া ভুলতে পারছে না। শশী কোথায় নালায় পড়বে, কোথায় কোন গাছতলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়বে—তাই সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। জিজ্ঞেস করুন না শশীকে!
শশী নাকি বলে—তার মরা-মা তার আশপাশে ঘুরে বেড়ায়। তাকে পাহারা দেয়। লোক থাকলে অবশ্য থাকে না। কিন্তু শশী একলা পথ চললে তখনই বুঝতে পারে যে তার মাও সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। সে নাকি তার কথাও শুনতে পায়! পথ ভুল হলে, কি খানা-খন্দ থাকলে তাকে সাবধান করে দেয়—দেঁখিস পঁড়ে যাঁবি।
বিনয় হাসলে। জীবনমশায় কিন্তু হাসলেন না।
শশীর মাকে ওরা জানে না যে। তিনি জানেন। এমন মা আর হয় না। সন্তানকে স্নেহ করে কোন মা? কিন্তু শশীর মায়ের মত স্নেহ তিনি দেখেন নি।।
শশীকে শুধু শশী বলে আশ মিটত না, বলতেন—শশীচাঁদ! আমার পাগল গো! একটু আধটু মদ খায়, নেশা করে—তা ধরে ফেলেছে—করবে কী বল?
যৌবনে শশী দুর্দান্ত মাতাল হয়ে উঠেছিল। দেশে ম্যালেরিয়া লাগল। শশী চ্যারিটেবল ডিসপেনসারির কম্পাউন্ডার। চার আনা আট আনা ফি। কুইনিন আর ম্যাগসাল ওষুধ—ওই ডিসপেনসারি থেকেই নিয়ে আসে। রােজগার অনেক। তখন শশী চিকিৎসাও খারাপ করত না। ডিসপেনসারির কাজ সেরে শশী প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে বের হত। সর্বপ্রথম খেয়ে নিত আউন্স দুয়েক মদ। তার আগে ডিসপেনসারিতেও আউন্স দুয়েক হত। খেয়ে বােতলে জল মিশিয়ে রেখে দিত। জিনিসটা না থাকলে খানিকটা রেকটিফায়েড স্পিরিটেই জল মিশিয়ে খেত। রােগী দেখা শেষ করে শশী ফিরবার পথে ঢুকত সাহাদের দোকানে। তারপর শুয়ে পড়ত, হয়। সেখানেই, নয়তো পথের ধারে কোনোখানে কোনো গাছতলায়। শশীর মা দাড়িয়ে থাকতেন বাড়ির গলির মুখে পথের ধারে। ক্রমে এক-পা এক-পা করে এগিয়ে, শেষে এসে উঠতেন সাহাদের দোকানে। শশীর প্রতি স্নেহের কাছে লজ্জা তার হার মানত। এসে ডাকতেন—সাহা!