আমি চিঠি উল্টে দেখলাম সব মিলিয়ে আঠারোটা পয়েন্ট আছে। আঠারোটা পয়েন্ট পড়ার এখন কোনো মানেই হয় না।
আমি চিঠি পড়া বন্ধ করে হাদি সাহেবের দিকে তাকালাম। হাদি সাহেব এতক্ষণ মনে হয় এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। চোখে চোখ পড়া মাত্র চোখ নামিয়ে নিলেন। কিছু কিছু মানুষ আছে কথা বলার সময় চোখের দিকে তাকায় না। অন্য সময় তাকিয়ে থাকে।
হাদি সাহেব মেঝের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলেন–মেয়েটা এক ফোটা চোখের পানি ফেলেনি।
আমি বললাম, আপনার কথাটা বুঝতে পারিনি। কে চোখের পানি ফেলেনি?
আমার মেয়েটার কথা বলছি–পাখি। তিনটা স্টিচ দিয়েছে কিন্তু চোখে পানি নেই। আমি শুধু হাত ধরে বসেছিলাম।
আপনার মেয়ে খুব সাহসী?
জ্বি না। সাহসী না, তেলাপোকা ভয় পায়। মাকড়সা ভয় পায়, শয়তানের ঘোড়া নামে একটা সবুজ রঙের পোকা আছে না, ঐটাকেও ভয় পায়। অত্যধিক ভয় পায়। তবে বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ড রাখে। যত বড় বিপদ, তার মাথা তত ঠাণ্ডা।
এইটুক মেয়ের আবার বিপদ কী?
বিপদ তো আর বয়স বিচার করে না। পঞ্চাশ বছরের একজন মানুষের যে বিপদ আসতে পারে পাঁচ বছরের একজন বাচ্চাও সেই বিপদে পড়তে পারে।
হাদি সাহেব উপহারের প্যাকেটটা আমাকে দিলেন। আমি আধুনিক গরুর গলার ঘন্টা প্যাকেট খুলে বের করলাম। হাতের তালুতে নেয়ার মত সুন্দর একটা খেলনা। খেলনাটার ব্যবহার হাদি সাহেব যতু নিয়ে শেখালেন। কোন বোতামের পর কোন বোতাম টিপতে হয় তা একটা কাগজে লিখেও দিলেন। যাবার আগে হঠাৎ করেই মুগ্ধ গলায় বললেনবিজ্ঞানের কি উন্নতি হয়েছে দেখেছেন স্যার। লোকজন টেলিফোন পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমি কী ঠিক করেছি জানেন স্যার আমার যদি কোনোদিন টাকা পয়সা হয়। আমি এ রকম দুটা ফোন কিনব। একটা থাকবে আমার কাছে, আরেকটা থাকবে আমার মেয়ের কাছে। এইসব অবশ্য কল্পনা, আমার কোনোদিন টাকা পয়সা হবে না।
টাকা পয়সা হবে না, কী ভাবে জানেন?
এক ফকির আমাকে বলেছেন। খুবই কামেল দরবেশ। ওনার দেশের বাড়ি বাগের হাট। মাঝে মধ্যে ঢাকায় এক মুরিদের বাড়িতে আসেন। তখন দেখা করি। ওনার জীন সাধনা আছে, পরী সাধনাও আছে। আমাকে বলেছেন একদিন জীন দেখাবেন। মানুষ তো অনেক দেখলাম। একটা জীন দেখার শখ ছিল। স্যার যাই?
আচ্ছা যান। জীন দেখার সুযোগ পেলে আমাকে বলবেন। মানুষ দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এখন জীন-ভূত দেখতে পারলে ভাল লাগার কথা।
সবার হাতে সব কিছু মানায় না। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকের হাতে বেত মানায় আবার ইউনিভার্সিটির শিক্ষকের হাতে মানায় না। নব্য ব্যবসায়ীর হাতে শ্ৰীফ। কেস মানায়, পুরানো ব্যবসায়ীর হাতে মানায় না। ক্যাডারদের হাতে জর্দার কৌটা মানায় কিন্তু ক্যাডারদের যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের হাতে মানায় না। মোবাইল টেলিফোনেরও কি হাতে মানাবার কোনো ব্যাপার আছে? হলুদ পাঞ্জাবি পরা খালি পায়ের একটা মানুষ কানে মোবাইল নিয়ে ঘুরছে এটি কি কোনো গ্রহণযোগ্য দৃশ্য? ঘোড়ায় চড়ে ভিক্ষুক ভিক্ষা করছে এটি বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলে গ্রহণযোগ্য দৃশ্য। ভিক্ষাকে সম্মানজনক জীবিকা হিসেবেই ধরা হয়। হঠাৎ কেউ একজন ঠিক করে সে তার বাকি জীবন ভিক্ষা করে কাটাবে। বিষয় সম্পত্তি যা আছে বিক্ৰী করে সে একটা ঘোড়া কেনে। ভিক্ষুকের যদি ঘোড়া থাকতে পারে, হিমুরও মোবাইল টেলিফোন থাকতে পারে।
হাদি সাহেবের মতে জ্ঞান–বিজ্ঞানে পৃথিবী ধাই ধাই করে এগুচ্ছে। এমন একটা সময় হয়ত আসবে যখন পৃথিবীর সব মানুষ যে–কোনো সময় একজনের সঙ্গে আরেকজন কথা বলতে পারবে। নাম্বারের বোতাম টিপতে হবে না, মনে মনে ভাবলেই হবে–আমি অমুকের সঙ্গে কথা বলতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে তার গলা শোনা যাবে।
চৈত্র মাসের দুপুরে পথে নেমেই আমার যদি দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে, তার কথা শুধু ভাবলেই হল। সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর পি এর গলা শোনা যাবে–
কে বলছেন, হিমু সাহেব? ভাল আছেন?
জ্বি ভাল।
প্রধানমন্ত্রী একটু টয়লেটে গেছেন। জানেন নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রীদেরও টয়লেট পায়। আপনি কি একটু ধরবেন না। দশ মিনিট পরে করবেন।
আমি ধরে আছি।
আপনি কোথেকে কথা বলছেন??
শাহবাগের মোড় থেকে।
খুবই গরম পড়েছে তাই না?
জ্বি চৈত্রমাসের তালু ফাটা গরম।
প্রধানমন্ত্রী এসে গেছেন–ধরুন।
আমি ধরেই আছি। প্রধানমন্ত্রী মিষ্টি গলায় বললেন, কে হিমু সাহেব?
জ্বি।
চৈত্র মাসের দুপুরে পথে পথে হাঁটছেন?
কী করব বলুন।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চলে আসুন। ঠাণ্ডা এক গ্লাস সরবত খেয়ে যান। বেলের সরবত।
আজ থাক, আরেক দিন।
আরেক দিন না। আজই আসুন। আসতেই হবে, না এলে আমি খুব রাগ করব। আপনি কোথায় আছেন বলুন তো গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। থাক থাক কোথায় আছেন বলতে হবে না— আধুনিক টেলিফোন সেটগুলি খুব ভাল বানিয়েছে। আপনি কোথায় আছেন তার কো অর্ডিনেট রেকর্ড হয়ে গেছে। আপনি অপেক্ষা করুন গাড়ি চলে আসছে। খোদা হাফেজ।
আমি টেলিফোন সেট কান থেকে নামাতে নামাতে প্ৰধানমন্ত্রীর নিজস্ব গাড়ি পো পো করে বাঁশি বাজাতে বাজাতে উপস্থিত হল। উপায় নেই বেলের সরবত খেতে যেতেই হবে।
পোঁ পোঁ গাড়ির শব্দ হচ্ছে ঠিকই। সেই শব্দ প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো গাড়ির শব্দ না। এম্বুলেন্স ছুটে যাচ্ছে–সেই শব্দ। একটা সময় ছিল যখন সাইরেন বাজিয়ে এম্বুলেন্স ছুটে গেলে সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবত—আহারে কাকে না জানি নিয়ে যাচ্ছে। বেচারা বাঁচবে তো?