- বইয়ের নামঃ একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁঝিঁ পোকা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিজির বইঃ হিমু সিরিজ
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
এই ছেলে, এই হলুদ পাঞ্জাবি
ভূমিকা
হিমু কখনো জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে না। ছোটখাট ঝামেলায় সে পড়ে। সেই সব ঝামেলা তাকে স্পর্শও করে না। সে অনেকটা হাঁসের মত। ঝাড়া দিল গা থেকে ঝামেলা পানির মত ঝরে পড়ল।
আমার খুব দেখার শখ বড় রকমের ঝামেলায় পড়লে সে কী করে। কাজেই হিমুর জন্যে বড় ধরনের একটা সমস্যা আমি তৈরি করেছি। এবং খুব আগ্রহ নিয়ে তার কাণ্ড–কারখানা দেখছি।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী, গাজীপুর।
০১.
আমার চেহারায় খুব সম্ভবত I am at your Service জাতীয় ব্যাপার আছে। আমি লক্ষ করেছি প্রায় সব বয়েসী মেয়েরা আমাকে দেখলেই টুকটাক কিছু কাজ করিয়ে নেয়। তার জন্যে সামান্য অস্বস্তিও বোধ করে না।
নিতান্ত অপরিচিত মহিলা নির্বিকার ভঙ্গিতে আমাকে বলবে–এই ছেলে, এই হলুদ পাঞ্জাবি, একটা রিকশা খুঁজে দাও তো। রিকশা না পেলে বেবিটেক্সি। মালীবাগ যাব। ভাড়া ঠিক করে এনো। কেয়ক
এই ধরনের কাজ আমি আগ্রহের সঙ্গে করি। দরদাম করে রিকশা ঠিক করি, জিনিসপত্র তুলে দেই। খট করে রিকশার হুড তুলি। এবং শেষপর্যায়ে প্রিয়জনদের উপদেশ দেবার মতো সামান্য উপদেশ দেই–শাড়ি টেনে বসুন। চাকার সঙ্গে পেঁচিয়ে যেতে পারে। হ্যাঁ এইবার হয়েছে।
শেষ উপদেশ রিকশাওয়ালাকে, রিকশা দেখেশুনে যাবে। No ঝাঁকুনি।
যার জন্যে এই কাজগুলি করা হয় তিনি খুব স্বাভাবিক থাকেন। আমার কর্মকাণ্ডে মোটেই বিস্মিত হন না। তিনি ধরেই নেন নিতান্ত অপরিচিত একজনের কাছ থেকে পাওয়া এই সেবা তার প্রাপ্য। রিকশা চলতে শুরু করলে আমার দিকে তাকিয়ে ভদ্রতার হাসি কেউ কেউ দেন। বেশিরভাগই দেন না। উদাস হয়ে থাকেন।
রহস্যটা অবশ্যই চেহারায়। কারোর চেহারাই থাকে মিথ্যুকের মত। তারা নির্ভেজাল সত্যি কথা বললেও সবাই হাসে এবং মনে মনে বলে–মায়ের কাছে খালাম্মার গল্প? মিথ্যার ব্যবসা আর কত করবে? এইবার খান্ত দাও না।
আবার কারোর চেহারা হয় সত্যুকের মত। যত বড় মিথ্যাই বলে মনে হয় সত্যি কথা বলছে।
কিছু চেহারা আছে চোর টাইপ। বেচারা হয়ত সাধু সন্ত মানুষ। স্কুলের অংক স্যার। শুধু চেহারার কারণে বাসে উঠলে বাসের অন্য যাত্রীরা চট করে পকেটে হাত দিয়ে মানিব্যাগ ঠিক আছে কি-না দেখে নেয়।
কসমেটিক সার্জারীতে চেহারা অদল–বদল করা হয় বলে শুনেছি। কসমেটিক সার্জনরা কি জানেন–মানুষের মুখের বিশেষ কোন জিনিসটির জন্যে সত্য ভাব, মিথ্যা ভাব, সাধু ভাব, চোর ভাব প্রকাশ পায়? জানা থাকলে খুব সুবিধা হত। চোর চেহারার মানুষ ছোট্ট একটা অপারেশন করিয়ে সাধু হয়ে যেত।
এ ধরনের উচ্চশ্রেণীর চিন্তা আমি করছি ইস্টার্ন প্লাজা নামক এক বিশাল শপিং মলের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে। শপিং মলে ঢুকব কি-না ভাবছি। চলন্ত সিঁড়ি আছে। বিনা পয়সায় রেলগাড়ি চড়ার মত সিঁড়িগাড়ি চড়া। আগে মানুষ হাঁটতো সিঁড়ি দাঁড়িয়ে থাকত। এখন সিঁড়ি হাঁটে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে।
Excuse me–
অল্পবয়েসী মেয়ের ঝনঝনে গলা।নিশ্চয়ই সে আমাকে কিছু করতে বলবে।
আমি ঘাড় ফেরালাম। ওকে আমাকে ক্ষমা করতে বলছে তাকে দেখা দরকার।
ক্ষমাপ্রার্থী এই তরুণীর বয়স বাইশ তেইশ। সাজগোজ একেবারেই নেই। সাজগোজ না-করে ক্যাজুয়েল থাকাটা বর্তমানের ফ্যাশান। অনেককে দেখছি চুল ছেলেদের মতো ছোট ছোট করে কাটছে। কানে বিচিত্র ধরনের দুল পড়ছে।
মাটির দুল : শান্তিনিকেতনী। শ্বাশত বাংলার মাটির গয়না উঠে এসেছে কানো। ও আমার দেশের মাটি
কাঠের দুল : জাপানী বাবাজীরা বাঁশ, কাঠ কিছুই ফেলছে না। রংচং মাখিয়ে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে।
প্লাস্টিকের দুল : ইউরোপীয়। প্রস্তর যুগ, লৌহ যুগ, তাম্র যুগের পর প্লাস্টিক যুগ।
লোহা লক্করের দুলা : অবশ্যই আমেরিকান। আমেরিকানরা অন্য সবার মত করবে না। আলাদা কিছু করবে। কাজেই তারা বানাচ্ছে এক কানের দুল। অন্য কান খালি।
কিছু কিছু দুল। এমনই বিচিত্র যে মেয়ের মুখের দিকে তাকানো হয় না। দুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সময় চলে যায়। আমার এক মামাতো বোন (রেশমী, ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। সেকেন্ড ইয়ার ফলিত রসায়ন।)। কানে যে দুল। পরে তা ফুলের টবের মতো। সেই টবে সবুজ পাতাওয়ালা গাছ আছে। একটা গাছে আবার পিচকি পিচকি নীল ফুল ফুটে আছে। আমি বললাম, রেশমী তোর এই টবে কি নিয়মিত পানি দিতে হয়? রেশমী বিরক্ত হয়ে বলল, পানি দিতে হবে কেন? এটা রিয়েল প্ল্যান্ট না, ইমিটেশন।
যে মেয়েটি মধুক্ষরা কণ্ঠে excuse me বলেছে তার কানে কোনো দুল নেই। সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে। শাড়ি পরে বোধ হয়। অভ্যাস নেই। নানান জায়গায় সেফটিপিন দেখা যাচ্ছে। গোলগাল মুখ। চোখে চশমা। চশমার ফ্রেম রূপালি। আমার মনে হল—রুপালি না হয়ে সোনালি ফ্রেমের চশমা হলে খুব মানাত। এই মেয়ের মুখ তৈরিই হয়েছে সোনালি ফ্রেমের জন্যে।
আপনি কি আমার একটা উপকার করতে পারবেন?
আমি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললাম, অবশ্যই পারব। একটা না, দুটা উপকার করব। একটা নরম্যাল উপকার। আরেকটা ফাউ।
মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে ভুরু কুঁচকে ফেলল। এই সময়ের মেয়েদের চরিত্রে দ্বৈত ভাব অত্যন্ত প্রবল। তারা পত্রিকায় ইন্টারভ্যু দেবার সময় বলবে–যে সব পুরুষের রসবোধ আছে, যারা কথায় কথায় রসিকতা করে তাদেরকেই তারা পছন্দ করে। সেইসব পুরুষ তাদের স্বপ্নের পুরুষ। বাস্তবে কোনো ছেলে রসিকতা করে কোনো মেয়েকে কিছু বললে সেই মেয়ে ভুরু কুঁচকাবেই। রসিকতা যত নির্মলই হোক, সেই মেয়ে রসিকতায় কলঙ্ক খুঁজে পাবে এবং মনে মনে বলবে–গোপাল ভাড় কোথাকার। সব সময় ফাজলামী।