গতকাল আসেন নাই কেন?
আমার মেয়েটা সিঁড়ি থেকে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে–এই জন্যে আসতে পারি নাই।
ও আচ্ছা।
হাদি সাহেব চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানছেন। চৈত্র মাসের গরমেও তার গায়ে খয়েরী রঙের কোট, গলায় টাই। ভদ্রলোকের স্বাস্থ্য বেশ ভাল। রেগে গেলে আমার মত স্বাস্থ্যের যে কোনো মানুষকে দুহাতে তুলে আছাড় দিতে পারবেন। হাদি সাহেব চোখ মেলে বললেন, মাথায় তিনটা ষ্টিচ দিতে হয়েছে। আমার মেয়েটার কথা বলছি।
বুঝতে পেরেছি। তিনটা স্টিচ। বলেন কি?
মেয়েটা অগ্রণী স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ে।
নাম কী?
ভাল নাম–সৈয়দা মেহেরুন্নেসা খানম। তার দাদীর নামে নাম রেখেছি। ডাক নাম এখনো রাখা হয়নি।
ক্লাস ফোরে পড়ে মেয়ে এখনো ডাক নাম রাখেননি। কী বলছেন!
কোনো নামই মনে ধরে না। এই জন্যে রাখা হয় নাই।
আপনি তাকে কী ডাকেন?
যখন যা মনে আসে ডাকি। কয়েক দিন ধরে পাখি ডাকছি।
শুধু পাখি? ময়না, টিয়া, কাকাতুয়া এইসব কিছু না?
জ্বি না। শুধু পাখি।
সৈয়দ হাদিউজ্জামান খান সাহেবের গলা এখন আর আগের মত শীতল লাগছে না। মেয়ের প্রসঙ্গ আসতেই গলা খানিকটা উষ্ণ হয়েছে। চেহারা থেকে তক্ষক ভাবাটাও মনে হয় কিছু দূর হয়েছে। আমার ধারণা ভদ্রলোক যদি নিজ কন্যা প্রসঙ্গে আরো ঘন্টাখানিক কথা বলেন তা হলে চেহারা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমি বললাম, ভাই এখন বলুন আমার কাছে কী জন্যে এসেছেন? মালিহা খালা পাঠিয়েছেন?
জ্বি। উনি আপনার জন্যে একটা উপহার পাঠিয়েছেন। আরেকটা চিঠি দিয়েছেন।
দেখি উপহারটা কী?
আগে চিঠিটা পড়তে বলেছেন।
হাদি সাহেব খাম বন্ধ চিঠি বের করে দিলেন। কিছু কিছু মেয়ে আছে যারা দীর্ঘ চিঠি লিখতে পছন্দ করে। কেমন আছিস? এই সাধারণ বাক্যটাকেও তারা ফেনিয়ে ফেনিয়ে আধা পৃষ্ঠা করে ফেলে। শুধু কেমন আছিস তারা কখনো লিখবে না, তারা লিখবে–
কী রে তুই কেমন আছিস? অর্থাৎ তোর শরীর কেমন তাই জানতে চাচ্ছি। শরীরটা ভাল তো? না-কি শরীর খারাপ? শরীরের দিকে তো তোর মন নেই। শরীর যদি যায় উত্তরে, তুই যাস দক্ষিণে…
মালিহা খালাও ঐ গোত্রের। তার চিঠি মানে চল্লিশ পাতার মিনি উপন্যাস। তবে আজকের চিঠিটা তুলনামূলক ভাবে সংক্ষিপ্ত। খালা লিখেছেন–
তুই কেমন মানুষ বল তো? গত তিন বছরে আমি খুব কম করে হলেও ত্ৰিশটা কার্ড পাঠিয়েছি। নিউ ইয়ার্স ড়ের কার্ড, হ্যালোইনের কার্ড থ্যাংকস গিভিং-এর কার্ড, ঈদ উপলক্ষে কার্ড। অনেকগুলির সঙ্গে ডলারও ছিল। তুই একটার জবাবও দেয়ার প্রয়োজন মনে করিসনি। তুই এমন কি তালেবর হয়ে গেছিস তা বুঝতে পারছি না। আমি ঠিক করে রেখেছিলাম দেশে ফিরে তোকে কঠিন শাস্তি দেব। এই শাস্তি তোর প্রাপ্য। কী শাস্তি দেব তাও তোর খালুর সঙ্গে মিলে প্ল্যান করে রেখেছি। তুই যদি ভাবিস আমি ঠাট্টা করছি তাহলে ভুল করবি। আমি মোটেই ঠাট্টা করছি না। শাস্তি ঠিকই দেয়া হবে।
দেশে ফিরেছি পনেরো দিনের মত হল। দুমাস ছুটির ওয়ান ফোর্থ পার হয়ে গেল তোর সঙ্গে দেখা হল না। আমি আমার বাড়ির কেয়ার টেকারকে এর মধ্যে কতবার যে পাঠিয়েছি। ওর নাম হাদি। স্ট্রেঞ্জ ধরনের মানুষ। আমার এখন সন্দেহ হচ্ছে ও বোধ হয় তোর কাছে যাচ্ছেই না। তোর কাছে যাবার নাম করে বের হচ্ছে। খানিকটা ঘুরে-ফিরে চলে আসছে।
তোকে আমার খুবই দরকার। কী জন্যে দরকার সাক্ষাতে বলব। ভাল কথা তোর সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার কি এখনো আছে? না চলে গেছে? তোকে আমার অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে। আমি মানসিক ভাবে সামান্য হলেও বিপর্যস্ত। ঘুমুতে গেলেই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নটা কী বলি– স্বপ্নে দেখি মুখোশ পরা একটা মানুষ আমার গলায় ইলেকট্রিকের তার পেচিয়ে আমাকে মেরে ফেলছে। মানুষটার গায়ে রসুনের গন্ধ। লোকটার পায়ে কোনো জুতা নেই। কালো মোজা পরা পা। যে-ইলেকট্রিকের তার দিয়ে সে আমার গলা পেচিয়ে ধরছে সেই তারটার রঙ সবুজ।
আমি আমেরিকায় সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে কথা বলেছি। তুই বোধ হয় জানিস না–আমেরিকায় সাইকিয়াট্রিষ্টের হেল্প নেয়া মানে জলের মত ডলার খরচ করা। জলের মতই ডলার খরচ করেছি। একেকটা সেশনে একশ ডলার করে লেগেছে, লাভ হচ্ছে না কিছু। ওরা হিপনোটিক ড্রাগ দিয়ে চিকিৎসা করছে। এই সব ড্রাগে খুব ঘুম হয়, তবে আরামের ঘুম হয় না। ঘুমের মধ্যেও টের পাওয়া যায় যে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। আর যদি কোনো কারণে একবার ঘুম ভেঙ্গে যায় তা হলে আর ঘুম আসে না। আমার এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে কোনো বাড়িতে একা থাকতে পারি না। বাথরুমে যদি শাওয়ার নিতে যাই তখন মনে হয়। বাথরুমের দরজা খোলা থাকলে কেউ ঢুকে পড়বে। আবার যদি দরজা বন্ধ করি তখন মনে হয়। এই বন্ধ দরজা আমি আর খুলতে পারব না। কী যে বিশ্ৰী অবস্থা। I need your help.
যাই হোক এখন অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি। তোর জন্যে একটা উপহার পাঠালাম। কী উপহার আন্দাজ কর তো। তোর তো আবার অনুমান শক্তি খুব ভাল। তোর সঙ্গে প্রথম যে বার দেখা হল সেই কথা মনে আছে না? ঐ যে তোকে বললাম–হিমু তোর যে সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল— তার একটা প্রমাণ দে তো। বল দেখি আজ আমি দুপুরে কী দিয়ে খেয়েছি। তুই সঙ্গে সঙ্গে বললি— তিন রকমের শুটকি। আমি আকাশ থেকে পড়লাম। অবশ্যি তোর খালু বলল–সিক্সথ সেন্স, সেভেন্থ সেন্সের কোনো ব্যাপার না। অনেক দিন পর বিদেশ থেকে যারা আসে তারা শুটকি–ফুটকি বেশি খায়। সেই হিসেবে বলেছে। আমি বললাম–তিন ধরনের শুটকির কথাটা কী ভাবে বলল? তোর খালু বলল, মানুষ তিন সংখ্যা খুব বেশি ব্যবহার করে। ক্রিসন্ধ্যা, তিন কাল, তিন পদ, তে মাথা…সেখান থেকে বলেছে। তোর খালু তোর সিক্সথ সেন্স বিশ্বাস না করলেও আমি করি। এবং ভালই বিশ্বাস করি। এখন তুই তোর ক্ষমতা জাহির করে বল উপহারটা কী? একটু হিন্টস দিচ্ছি গরুর গলায় যেমন ঘন্টা থাকে তোর জন্যে সে রকম একটা ঘন্টা কিনেছি। গলায় ঘন্টা ঝুলানো গরু যেখানে যায়–ঢং ঢেং করে ঘন্টা বাজে মালিক টের পায় গরু কোথায় গেল। তোর উপহারটাও সে রকম। তুই যেখানে যাবি আমি জািনব কোথায় গিয়েছিস। আন্দাজ করতে পারছিস উপহারটা কী? একশ ডলার বাজি, পারছিস না। যাই হোক তোকে টেনশনে রেখে লাভ নেই আমিই বলে দিচ্ছি। একটা মোবাইল টেলিফোন। তোকে আল্লাহর দোহাই লাগে। তুই যেখানে যাবি–টেলিফোনটা সঙ্গে নিয়ে যাবি। এটা এমন কোনো ভারী বস্তু না। পকেটে ফেলে রাখলেই হল।
টেলিফোন সঙ্গে নিয়ে যাবি। যাতে ইচ্ছে করলেই আমি টেলিফোনে তোকে পাই। আমার অবস্থা এমন হয়েছে যে আমি একা একা তিন মিনিটও থাকতে পারি না। কাউকে না কাউকে টেলিফোন করতে হয়। তুই অতি অবশ্যি টেলিফোন সঙ্গে রাখবি এবং অন করে রাখবি। ফোনের বিলের জন্যে তোকে চিন্তা করতে হবে না। আমি বিল দিয়ে দেব। অবশ্যি আমি আমেরিকা ফিরে যাবার পর–You are on your own. অর্থাৎ নিজের বিল নিজে দিবি।
হাদি তোকে খুব ভাল করে বুঝিয়ে দেবে কী ভাবে কল রিসিভ করতে হয়। কী ভাবে কল করতে হয়। তারপর হিমু তোর খবর কী বল। হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটাহাঁটির রোগটা কি কমেছে না। আরো বেড়েছে? চিকিৎসা না করলে সব ব্যধিই বাড়ে কাজেই আমার ধারণা তোর ব্যধিও বেড়েছে। তবে তোর ব্যধিটা যেহেতু খুব ক্ষতিকর না, কাজেই হজম করা যেতে পারে।
শোন হিমু তোকে আমার জন্যে বেশ কিছু কাজ করতে হবে। কাজগুলি কী আমি পয়েন্ট দিয়ে দিয়ে লিখছি। নাম্বার ওয়ান…