জুঁই তোমাকে কখনো বাসায় চা খেতে বলেনি?
বলেছে।
তুমি যাওনি?
জ্বি না।
এখন যাবে। চা খেতে যাবে। গল্প করতে যাবে। এবং অতি অবশ্যই আসল খবরটা জুঁই-এর কাছ থেকে বের করবে। নাও এই কার্ডটা রােখ। এখানে আমার বাসার ঠিকানা এবং টেলিফোন নাম্বার আছে।
স্যার এক গ্রাস পানি খাব।
ভদ্রলোক বেল টিপলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একজন পানির গ্লাস নিয়ে ঢুকাল। পানির কথা বলতে হল না। এটা কি ভাবে সম্ভব হল বুঝতে পারলাম না। বেল টেপার মধ্যেই কি কোনো সংকেত আছে। এই ধরনের বেল মানে চা, এই টাইপ বেলা হল–পানি। আরেক ধরনের বেলের অর্থ সামনে যে বসে আছে তাকে ধরে মারা লাগাও।
পানি খাব না। স্যার।
ভদ্ৰলোক শীতল চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি কাচুমাচু মুখ করে বললাম, পুলিশ অফিসগুলিতে পানি খাওয়া ঠিক না। এদের পানির ট্যাংকে ডেডবডি থাকে। পত্রিকায় পড়েছি।
আই সি। তা হলে পানি না খাওয়াই ভাল।
আমি বের হয়ে এলাম এবং মোটামুটি নিশ্চিত ভাবে জেনে গেলাম আমি শক্ত পাল্লায় পড়েছি। ইনি সহজ পাত্র না।
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে কেউ যদি দেখে তার পাশে এমন একজন লোক বসে আছে যার চেহারা তক্ষকের মত, এবং সে ক্রমাগত মুখ নাড়ছে। কিন্তু মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। তখন কী করা উচিত? লাফ দিয়ে উঠে বসে–কে কে বলে চিৎকার করা উচিত, না-কি প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলাবার জন্যে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলা উচিত?
আমি লাফ দিয়ে উঠে না বসে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি বিবেচনা করা যাক। ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা করলে হয়ত দেখা যাবে ব্যাপারটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। জগতের অতি স্বাভাবিক ঘটনাগুলিও শুধু পরিস্থিতির কারণে অস্বাভাবিক মনে হয়।
যেহেতু আমার ঘরের দরজা সব সময় খোলা থাকে সেহেতু যে কেউ আমার ঘরে ঢুকতে পারে।
লোকটা চেয়ারে না বসে আমার গা ঘেসে বিছানায় বসে আছে। এরও যুক্তি সঙ্গত কারণ আছে। আমার চেয়ারের একটা পা নড়বড়ে। সে হয়ত চেয়ারে বসতে গিয়ে ভরসা না পেয়ে আমার বিছানায় বসেছে।
লোকটার চেহারা তক্ষকের মত। এটা খুবই অস্বাভাবিক ধারণা। তক্ষক সরিসৃপ জাতীয় প্রাণী। মানুষ হোমোসেপিয়ান–তার চেহারা তক্ষকের মত হতে পারে না। লোকটার চোখ দুটা হয়ত বড় বড় এবং দুটা চোেখই অক্ষিগোলক থেকে সামান্য বের হয়ে আছে। এ রকম প্রায়ই দেখা যায়। থাইরয়েড গঠিত সমস্যায় এরকম হয়, চোখ কোটির থেকে খানিকটা বের হয়ে থাকে। ভদ্রলোকেরও তাই হয়েছে। সে কারণেই তাকে হয়তোবা খানিকটা তক্ষক বা টিকটিকির মত লাগছে।
বাকি থাকল মুখ নাড়ানো। মুখ নাড়ছে ঠোঁট নাড়ছে, শব্দ হচ্ছে না। অনেক সময়ই মানুষের মুখ নড়ে, ঠোট নড়ে, শব্দ হয় না। যেমন পান খাবার সময়, চুইং গাম চিবানোর সময়। লোকটা নিশ্চয়ই পান খাচ্ছে কিংবা চুইং গাম চিবুচ্ছে। পুরো ব্যাপারটায় সাধারণ ব্যাখ্যা আছে। কাজেই সহজ ভাবে আমি চোখ মেলতে পারি এবং উঠে বসতে বসতে বলতে পারি–ভাই কেমন আছেন? আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না। কোথায় দেখেছি বলুন তো?
এই প্রশ্নের উত্তরে তক্ষক–ভদ্রলোক হয়ত বলবেন, আপনি আমাকে আগে কখনো দেখেননি। আমি পুলিশের লোক। জুঁই-এর বাবা আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনার উপর। সারাক্ষণ লক্ষ রাখার কথা তো–এই জন্যেই বসে আছি। লক্ষ রাখছি। ভাল আছেন?
আমি উঠে বসলাম। চোখ মেললাম, কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক বললেন, আপনি কি হিমু? ভদ্রলোকের গলার স্বর অ্যান্টার্কটিকার বাতাসের মতই শীতল। এমন শীতল কণ্ঠস্বর সচরাচর শোনা যায় না। ভদ্রলোক এই ঘরে বসে দশ মিনিট বক্তৃতা দিলে ঘরের তাপ দশ ডিগ্ৰী কমে যাবার কথা।
আপনার নাম হিমু?
জ্বি আমার নাম হিমু।
আপনি মালিহা বেগম নামে কাউকে চেনেন??
জ্বি না। চিনি না।
ভাল করে চিন্তা করে বলুন।
ভাল করে চিন্তা করেই বলছি, এই নামে কাউকে চিনি না।
উনি আমেরিকায় থাকেন সম্পর্কে আপনার খালা হন। দূর সম্পর্কের খালা।
ও আচ্ছা মালু খালা। ওনারা দুই বোন, একজনের নাম মালিহা, তাকে ডাকতাম মালু খালা। আরেক জনের নাম সালেহা। তাঁকে ডাকতাম সালু খালা। সালু খালার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। তবে মালু খালার সঙ্গে আছে। উনি প্রতি নিউ ইয়ার্সে একটা কার্ড পাঠান। শুধু কার্ড না, কার্ডের সঙ্গে ডলার থাকে। মালিহা খালার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী?
কোনো সম্পর্ক নাই। ঢাকায় ওনার যে বিষয় সম্পত্তি আছে তা দেখ ভাল করি। আমি কি আপনার ঘরে একটা সিগারেট খেতে পারি?
অবশ্যই পারেন।
আমার নাম হাদি।
কী নাম বললেন, হাদি
জ্বি হাদি। সৈয়দ হাদিউজ্জামান খান।
ও আচ্ছা। নাম তো খুবই জবরদস্ত।
হাদি সাহেব সিগারেট ধরালেন। ভদ্রলোককে এখনো তক্ষকের মতই লাগছে। তার চোখ ঠিক আছে, মুখের শেপের কোনো সমস্যার জন্যেই বোধ হয় তক্ষক ভাব এসেছে। সমস্যাটা আমি ধরতে পারছি না। ভদ্রলোক পান বা চুইং গাম কিছুই খাচ্ছেন না। মাঝে মধ্যে মুখ নাড়ানো সম্ভবত ওনার অভ্যাস। ভদ্রলোকের চেহারা যেমনই হোক–তিনি পুলিশের লোক না এটা ভেবেই শান্তি শান্তি লাগছে। পুলিশের চেয়ে তক্ষক ভাল।
হিমু সাহেব।
জি।
আপনার মালিহা খালা সামারের ছুটি কাটাতে দেশে এসেছেন। দুই মাস থাকবেন। আপনার সঙ্গে যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেছেন।
ও।
চেষ্টা উনি করেন নাই। আমি করেছি। এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন দুইবার করে এসেছি। শুধু গতকাল আসি নাই।