মালেকা বানু কোনো উত্তর না-দিয়ে টেলিফোন সেট এগিয়ে দিয়ে উঠে দাড়ালেন। টেলিফোনের কথাবার্তা তিনি শুনতে চান না। ভদ্রমহিলার ভদ্রতায় আরেকবার মুগ্ধ হলাম।
টেলিফোন করলাম নিজের মোবাইলের নাম্বারে। টেলিফোন ধরলেন জুঁই-এর বাবা। তিনি হতাশ এবং ক্লান্ত গলায় বললেন–কে?
আমি বললাম, হিমু। ও তুমি। জুঁই-এর কোনো খবর পেয়েছ?
জ্বি না, আপনি পেয়েছেন?
ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, স্যার আপনি যে আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়ে রেখেছিলেন–ওরা কি এখনো আছে?
না। ওরা হঠাৎ একদিন তোমাকে মিস করেছে। তারপর আর তোমাকে লোকেট করতে পারছে না।
স্যার আপনি বোধহয় এক্সপার্ট কাউকে দেননি। শিক্ষানবিশ কাউকে পাঠিয়েছিলেন। এখন আমি আছি ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ডাঃ মালেকা বানুর চেম্বার।…
হিমু শোনো…অর্থহীন কথা বলে আমার সময় নষ্ট করবে না। আমি আমার মেয়েকে পাচ্ছি না, আই এ্যাম অলমোস্ট এটা দি পয়েন্ট অব লুজিং মাই সেনিটি… আমি দুরাত ঘুমাইনি। আমার ধারণা মেয়েটা মহা বিপদে পড়েছে। খুব খারাপ একটা টেলিফোন কল পেয়েছি…
আমি টেলিফোনে ফোঁপানির মত শব্দ শুনলাম। ভদ্রলোক কাঁদছেন নাকি? কাঁদাটাই স্বাভাবিক।
আমি বললাম, স্যার আমি জুঁই-এর খবর আপনাকে দিতে পারি।
কী বললে? জুঁই-এর খবর দিতে পার?
অবশ্যই পারি।
কোথায় আছে সে?
সে কোথায় আছে তা এক শর্তে আপনাকে বলতে পারি।
ডোন্ট টক নুইসেন্স। তোমার কাছে পুলিশের লোক যাচ্ছে–তুমি এক্ষুনি এই মুহুর্তে জুঁই-এর কাছে তাদের নিয়ে যাবে। আমিও সঙ্গে আসছি। এখন বলো এখন তুমি কোথায় আছ?
স্যার আপনি মন দিয়ে আমার কথা শুনুন। চিৎকার চেচামেচি করে কোনো লাভ হবে না। আপনার বা আপনার বাহিনীর সাধ্যও নেই আমাকে খুঁজে বের করার। আপনি আমার শর্ত মানলেই মেয়েকে পাবেন।
শর্তটি কী? তোমার কী লাগবে। টাকা?
টাকা না, একটা হাতির বাচ্চা।
তার মানে?
একদিনের জন্যে আপনি একটা হাতির বাচ্চা জোগাড় করে দেবেন। এ মাসের বারো তারিখ।
হাতীর বাচ্চা আমি কোথায় পাব?
আপনার মত ক্ষমতাবান মানুষের পক্ষে হাতির বাচ্চা জোগাড় করা কোনো ব্যাপারই না। হাতির বাচ্চাটা জোগাড় করুন। বারো তারিখ ভোরবেলা আমি আপনাকে একটা ঠিকানা দেব। ঐ ঠিকানায় হাতির বাচ্চা নিয়ে চলে যাবেন। মেয়েকেও পেয়ে যাবেন।
আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। অতি দ্রুত এখন আমাকে চলে যেতে হবে। জুঁই-এর বাবা এখন থেকে হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজবেন, যদি পেয়ে যান তা হলে আর হাতির বাচ্চার ব্যবস্থা হবে না। আমাকে না পেলে তিনি অবশ্যই হাতির বাচ্চা জোগাড় করবেন।
খুব বেশি কাছে বলেই তাকে দেখা যায় না
আমি মুসলেম মিয়ার সঙ্গে কয়েকদিন ধরে আছি। দুজনই পলাতক। মুসলেম পলাতক তার ভক্তদের কাছ থেকে, আমি পলাতক জুঁই-এর বাবার কাছ থেকে। পালিয়ে কেউ কেউ বস্তিবাসী হয়, আমরা দুজন হয়েছি পাইপবাসী। বিশাল এক সু্যায়ারেজ পাইপে সংসার পেতেছি। পাইপের দুমাথা চটের পর্দায় ঢাকা। বাইরের জগৎ থেকে চটের পর্দায় আমরা বিচ্ছিন্ন। আমাদের সঙ্গে আরো পাইপ–সংসার আছে। এখানকার ব্যবস্থা আধুনিক ফ্ল্যাটবাড়িগুলির মত। এক ফ্ল্যাটের মানুষ যেমন অন্য ফ্ল্যাটে কী হচ্ছে খবর রাখে না, পাইপ জগতেও এক পাইপের সংসার জানে না। অন্য পাইপে কী হচ্ছে।
আমরা মোটামুটি সুখেই আছি। তবে মুসলেম মিয়া খুবই যন্ত্রণা করছে। সারাক্ষণ হা হুতাশ— ভাইজান আপনের কথা শুইন্যা বৃষ্টির পানিতে নেংটিা হইয়া নাচলাম। এরপরেই যে কী হইল ভাইজান। এখন মানুষের মনের কথা বুঝি। কে মনে মনে কী ভাবতাছে পরিষ্কার ধরতে পারি। এই যেমন ধরেন আপনে এখন ভাবতেছেন একটা হাতির বাচ্চার কথা। সত্য বলতেছি কি-না বলেন ভাইজান।
আমি বিস্মিত হয়ে বলি, হ্যাঁ সত্য বলছি। হাতির বাচ্চার কথাই ভাবছি।
তারপর ধরেন। বেলী ফুলের গন্ধ। সারা শইল দিয়া ভুরিভুর কইরা গন্ধ বাইর হয়। আইজা সকালে একবার গায়ে মাখা সাবান দিয়া গোসল দিছি। দুপুরে গোসল দিছি কাপড় ধোয়া সাবান দিয়া। তারপরেও গন্ধ যায় না। কী করি ভাইজান বলেন।
কী করতে চাও?
আগের মত হইতে চাই। পীর ফকির হইতে চাই না। পাপ করতে ইচ্ছা করে।
ইচ্ছা করলে পাপ করো।
আমার যে অবস্থা ভাইজান আর তো মনে হয় পাপ করতে পারব না। পাপাই যদি করতে না–পারি পৃথিবীতে বাইচা লাভ কী? দুনিয়ার আসল মজা পাপে। পুণ্যির মজা নাই। কোনো একটা তরিকা আমারে বলেন যেন সব আগের মত হয়। ফুলের গন্ধটা অসহ্য হইছে ভাইজান। এরচে শইল্যে গু মাইখ্যা বইসা থাকা ভাল। এই যে দিন রাইত পাইপের মইধ্যে লুকাইয়া থাকি এইটা কি ভাল?
চলো আজ রাতে বের হই। কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করি।
আপনে যা বলবেন করব। গু খাইতে বললে, বিসমিল্লাহ বলে কাচা গু খাব। খালি আমারে আগের মত বানায়া দেন।
আমি মুসলেম মিয়াকে নিয়ে বের হলাম।
আজ বারো তারিখ। পাখির জন্মদিন। জন্মদিন হচ্ছে কি-না খোজ নেয়া দরকার। জুঁই এর বাবাকে সকালবেলা পাখিদের বাসার ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি। তিনি হাতির বাচ্চা নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন কি-না সেটাও জানা দরকার।
পাখিদের বাড়ির কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়াতে হল। বাড়ির সামনে বিরাট জটলা। অনেক লোকজন। ব্যাপার কী জিজ্ঞেস করতেই একজন হড়বড় করে বলল, এই বাড়িতে একটা হাতির বাচ্চা নিয়ে একজন গেছে।