থানা কি সামাজিক মেলামেশার জায়গা? কোনো কাজে এসে থাকলে বলুন, আর কাজ না থাকলে চলে যান।
সামান্য কাজ ছিল।
সেটা কি?
হাদি সাহেবকে বলা যে তার মেয়েটা ভাল আছে।
হাদিটা কে?
হাদিউজ্জামান খান। খুনের আসামী।
বুঝতে পেরেছি। ও তো নেই।
নেই মানে কি?
ওসি সাহেব হাই তুলতে তুলতে বললেন, বসুন বলছি। সামান্য ঘটনা আছে।
আমি সঙ্গে সঙ্গে গলা নামিয়ে বললাম, মেরে ফেলেছেন নাকি? ডেড বডি কোথায় রেখেছেন? পানির ট্যাংকে? রিস্কি হয়ে যাবে তো।
রকিবউদ্দিন সাহেব অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। তবে এই বিরক্তি দীর্ঘস্থায়ী হল না। তিনি সিগারেট ধরালেন এবং সিগারেটের প্যাকেট আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ব্যাটাকে মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে।
আমি বললাম, কেন?
পেটের ভেতর থেকে কথা বের করার জন্যে সামান্য ডালা দেয়া হয়েছিল। ডলাটা বেকায়দায় পড়ায় জ্ঞান হারিয়েছিল। ডলা খেয়ে অভ্যোস নেই তো।
সেই জ্ঞান আর ফেরেনি?
নাহ্।
জ্ঞান ফিরবে? না-কি আর ফিরবে না?
আমি কী করে বলব? ডাক্তার বলতে পারবে।
মানুষটা যদি মারা যায় আপনাদের কোনো ঝামেলা হবে না?
ঝামেলা হবে কেন?
আপনাদের ডলা খেয়ে মারা গেল।
ওসি সাহেব হাই তুলতে–তুলতে বললেন, কোনো ঝামেলা নাই—থানায় এফ আই আর করা আছে–আসামী গভীর রাতে হাজাতের শিকে মাথা ঠুকছিল। রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে নিবৃত্ত করা হয়।
ও।
চা খান। দিতে বলব?
বলুন।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে–দিতে বললাম, এই যে ঘটনাগুলি ঘটে— আপনাদের হাতে লোকজন মারা যায় আপনাদের খারাপ লাগে না?
ওসি সাহেব সিগারেটে লম্বা টান দিতে–দিতে বললেন, সত্যি কথা জানতে চান?
হ্যা জানতে চাই।
পরনে যখন খাকি পোষাক থাকে তখন খারাপ লাগে না। বাসায় গিয়ে যখন লুংগি গেঞ্জি পরি তখন খারাপ লাগে।
আমি বললাম, পুলিশের পোষাক পাল্টে লুংগী গেঞ্জি করলে ভাল হত। তাই না?
রকিবউদ্দিন সাহেব ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, লুংগি গেঞ্জি? লুংগী পরে আমরা আসামীর পেছনে দৌড়াব?
অসুবিধা কী? মালকোচা মেরে দৌড় দেবেন।
ওসি সাহেব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এখানে আর বেশি সময় থাকা ঠিক হবে না। চা-টা ভাল হয়েছিল। পুরো কাপ শেষ করলে ভাল হত। শেষ করা ঠিক হবে না। এই সময়ে বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে।
আমি উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললাম—হাদি সাহেব কোথায় আছে বলবেন? একটু দেখে আসতাম! পুলিশের ডলা কী জিনিস সে সম্পর্কে ফাস্ট হ্যান্ড নলেজ নিয়ে আসতাম।
ওসি সাহেব যন্ত্রের মত বললেন, মেডিকেলে। ইনটেনসিভ কেয়ারে।
ভেবেছিলাম আমাকে দেখেই ডঃ মালেকা বানু তেলেবেগুনে টাইপ জ্বলে উঠবেন। কর্কশ গলায় গেট আউট বলে বসবেন এবং বেল টিপে দারোয়ান ডাকাবেন।
সেরকম কিছুই করলেন না। শান্ত গলায় বললেন, হিমু সাহেব। আসুন।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। কারো কাছ থেকে খুব খারাপ ব্যবহার পাব এ জাতীয় মানসিক প্ৰস্তৃতি নিয়ে যাবার পর হঠাৎ যদি খুব ভাল ব্যবহার পাওয়া যায় তা হলে সব এলোমেলো হয়ে যায়। আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না।
মালিকা বানু বললেন, বসুন। তেতুলের সরবত খাবেন? আমার বড় মেয়ে কোথেকে জানি তেতুলের সরবত বানানো শিখে এসেছে। রোজ ফ্রাঙ্ক ভর্তি করে তেতুলের সরবত দিয়ে দিচ্ছে। আমি আবার টক খেতে পারি। না। মেয়েটাকে সেই কথা বলতেও পারছি না। বেচারী এত শখ করে একটা জিনিস বানাচ্ছে।
আমি বললাম, দিন তেতুলের সরবত।
মালেকা বানু হাসিমুখে গ্লাসে তেতুলের সরবত ঢাললেন। আমার দিকে গ্লাস বাড়িয়ে দিতে–দিতে বললেন, আজও কি আপনি আপনার খালু সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে এসেছেন?
আমি তেতুলের সরবতে চুমুক দিতে–দিতে বললাম, জি না। আজ এসেছি। হাদিউজ্জামানের সঙ্গে কথা বলতে।
থানা থেকে যাকে পাঠিয়েছে সেই হাদিউজ্জামান?
জ্বি। আচ্ছা আপা আপনি বলুন তো হাদিউজ্জামানের বিছানা এবং আমার খালুসাহেব আরেফিন সাহেবের বিছানা কি পাশাপাশি।
হ্যাঁ পাশাপাশি। আমি স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তা হলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।
মালেকা বানু চোখ সরু করে বললেন, কী রকম?
আমি বললাম, আমার ধারণা প্রকৃতি বা আল্লাহ বা মহাশক্তি পুরো ব্যাপারটা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে। দুজনকে ইনটেনসিভ কেয়ারে পাশাপাশি শুইয়ে দিয়েছে। কাজেই এখন বোঝা যাচ্ছে তার পরিকল্পনা মতোই সব কিছু হচ্ছে। আমাদের দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ হবার কিছু নেই।
আপনি দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ ছিলেন?
হ্যাঁ ছিলাম। আমার ধারণা আমার খালুসাহেবই খুনটা করেছেন। স্ত্রীর সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে আহত হয়েছেন। কারণ আমার খালাও খুব সহজ পাত্রী না। অপরাধটা নিজের ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলে দিয়েছেন হাদিউজ্জমানের ঘাড়ে। যাই হোক এখন যেহেতু দুজন পাশাপাশি আছে প্রকৃতি ব্যাপারটার দ্রুত মিমাংসা করে ফেলবে। দেখা যাবে বারো তারিখে হাদিউজ্জামান সাহেব তার মেয়ের জন্মদিনে উপস্থিত হবেন।
ডঃ মালেকা বানু আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার দুচোখে শান্ত কৌতুহল। তার চোখ দুটি বলে দিচ্ছে। আমি নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করব না। তবু তুমি যদি কিছু বলো তা হলে খুব আগ্রহ নিয়ে শুনব।
আমার কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। ক্লান্তি লাগছে। ইচ্ছা করছে পার্কের কোন বেঞ্চিতে শুয়ে থাকতে। আকাশের যে অবস্থা বৃষ্টি নামবেই। পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে বৃষ্টিতে ভেজার মজা অন্য রকম।
আমি বললাম, আপা আপনার টেলিফোনটা কি একটু ব্যবহার করতে পারি?