আমার বাবা তার উপদেশমালায় লিখে গেছেন–
বাবা হিমালয়, তোমাকে বাস করিতে হইবে অনেকের মধ্যে। লক্ষ রাখিও সেই অনেকের কেউই যেন তোমাকে কখনো চালাক বা বুদ্ধিমান মনে না করে। মহাপুরুষরা চালাক হন না, বুদ্ধিমান হন না, আবার তারা বোকাও হন না। পৃথিবীর এই অনিত্য জগতে বুদ্ধির স্থান নাই। বুদ্ধি দ্বারা এই জগত বুঝিবার চেষ্টা করিবে না। চেতনা দ্বারা বুঝিবার চেষ্টা করিবে। বুদ্ধি চেতনাকে নষ্ট করে… …
রূপার শরীর ভাল নেই।
এই প্ৰচণ্ড গরমেও সে চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছে। চোখ মুখ ফোলা। নাক দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে। কোলে রাখা টিস্যু বক্স দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। রূপা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কত দিন পরে তোমাকে দেখলাম বলো তো।
আমি বললাম, প্ৰায় এক বছর।
রূপা বলল, এক বছর সাত মাস, ন দিন।
ঘণ্টা মিনিট বাদ দিলে কেন?
ঘণ্টা মিনিটও বলতে পারব। বলতে ইচ্ছা করছে না বলে বলছি না। তোমার সঙ্গের এই মেয়েটি কে?
ওর নাম পাখি। ও তোমার সঙ্গে কিছুদিন থাকবে। বারো তারিখ ওর জন্মদিন। জন্মদিনের দিন আমি ওকে নিয়ে যাব।
রূপা কিছু বলল না। আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, তোমার কী হয়েছে?
রূপা বলল, আমার তেমন কিছু হয়নি। তোমার কতদূর কী হয়েছে সেটা বলো। মহাপুরুষ হতে পেরেছ?
না।
চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছ? এই মেয়েটাকে যে আমার এখানে রেখে যাচ্ছ এটাও কি তোমার মহাপুরুষ-কৰ্মশালার অংশ?
আমি হাসলাম।
রূপা বলল, প্লীজ হাসবে না। তোমার হাসি কোনো দিনই আমার ভাল লাগেনি। যত দিন যাচ্ছে তোমার হাসি ততই বিরক্তিকর হচ্ছে। হায়নার হাসিও তোমার হাসির চেয়ে সুন্দর।
আমি বললাম, রূপা হাসি বন্ধ। আমি চলে যাচ্ছি। তুমি পাখিকে ডেকে ওর সঙ্গে একটা দুটা কথা বল। নতুন এক বাড়িতে সে থাকতে এসেছে তার এন্ট্রিটা সহজ করে দাও। ও তোমার কঠিন মূর্তি দেখে ঠিক ভরসা পাচ্ছে না।
রূপা হাত ইশারায় পাখিকে ডাকল। পাখি শংকিত পায়ে এগিয়ে এল। রূপা কঠিন গলায়, মাস্টারনীর ভঙ্গিতে বলল, এই মেয়ে তোমার নাম কি?
পাখি ভয়ে ভয়ে বলল, পাখি।
পাখি তোমার নাম?
জ্বি।
তুমি কি উড়তে পার?
না।
না বলে লাভ নেই। যেহেতু তোমার নাম পাখি সেহেতু তোমাকে আকাশে উড়তে হবে। আমি ওয়ান টু থ্রি বলব সঙ্গে সঙ্গে ওড়া শুরু করবে। ওয়ান-টু-থ্রি। কই উড়ছি না কেন?
পাখি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। রূপা তার বিখ্যাত খিলখিল হাসি শুরু করেছে। আমি এই হাসির নাম দিয়েছিলাম জলতরঙ্গ হাসি। রূপার এই হাসির শব্দটাতেই একটা ম্যাজিক আছে। শব্দ শুনলেই মনে হয়–এটা শুধু হাসি না। হাসি দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে দেয়া। হাসির মাধ্যমে কাছে ডাকা।
আমি যা ভাবছিলাম। তাই হল, হাসির শব্দ শুনেই পাখি ছুটে এসে রূপাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। বাচ্চা মেয়েটির বুকে অনেক অশ্রু জমে আছে। আশ্রম বের হওয়া দরকার।
আমি ওদেরকে রেখে আবার পথে নামালাম। আকাশ মেঘলা। রবীন্দ্রনাথের গানের মত মেঘের উপর মেঘ করে আঁধার হয়ে আসছে। এমন দিনে হাঁটতে চমৎকার লাগে।
দশ গজ যাইনি তার আগেই গা ঘেসে একটা গাড়ি থামল। গাড়ির কাচ নামিয়ে বোরকা পরা এক মহিলা চাপা গলায় বললেন, তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠুন।
আমি গাড়িতে উঠলাম। বোরকাওয়ালী বললেন, ভাল আছেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ। আমাকে চিনতে পেরেছেন?
না।
বোরকা পরলেও আমার চোখ তো দেখা যাচ্ছে। চোখ দেখেও চিনতে পারছেন না?
পারছি না।
আমার গলার স্বরও চিনতে পারছেন না?
না। মেয়েদের গলার স্বরের মধ্যে একমাত্র রূপার গলার স্বর আমি চিনতে পারি। আর কারোর গলা চিনতে পারি না।
রূপা কে? আচ্ছা থাক বলতে হবে না বুঝতে পারছি কে! এবং আমার ধারণা আপনিও বুঝতে পারছেন আমি কে।
তুমি জুঁই। বোরকা পরেছ কেন? কোনো মওলানা বিয়ে করেছ?
জুঁই হেসে ফেলল। শব্দ করে হাসি। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার তার হাসিও রূপার হাসির মত। বনবান করে জলতরঙ্গের মত বাজছে। কাছে ডাকার হাসি।
খিলখিল করছি কেন?
খিলখিল করছি। কারণ আপনাকে দেখে খুব মজা লাগছে। আপনি কি জানেন আমি পাগলের মত আপনাকে খুঁজছি। আপনার একটা মোবাইল টেলিফোন ছিল না? সেই নাম্বারটাও ভুলে গেছি। আমি আবার নাম্বার মনে রাখতে পারি না। ম্যাট্রিকের রোল নাম্বার কোনো ছেলে মেয়ে ভোলে না। অথচ আমি ভুলে গেছি। আচ্ছা আপনার কি ম্যাট্রিকের রোল নাম্বার মনে আছে?
আমি বললাম, তুমি এত আনন্দিত কেন?
জুঁই হাসতে-হাসতে বলল, আমি আনন্দিত কারণ চোর–পুলিশ খেলায় আমি বাবাকে হারিয়ে দিয়েছি। আপনি তো জানেন না বাবা আমার জীবন অতিষ্ট করে দিয়েছিল। আমার পেছনে সব সময় দুতিনজন স্পাই। কোথায় যাই–না–যাই সব বাবা জানেন। আমার ঘরে যে টেলিফোন সেখানেও এমন ব্যবস্থা করা ছিল আমি যখন যার সঙ্গে কথা বলছি সব রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে।
তোমার অবস্থা তো তা হলে মনে হয় খারাপই।
হ্যাঁ খারাপ। খুব খারাপ। বাবা যে শুধু আমার পেছনে স্পাই লাগাতেন তা–না, আমি যদি কোনো ছেলের সঙ্গে কয়েকবার কথা বলতাম তা হলে তার পেছনেও স্পাই লাগিয়ে দিতেন।
গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করার জন্যে মনে হয় এটা হয়েছে।
জুঁই সহজ গলায় বলল, আমার মা বাবাকে ছেড়ে পালিয়ে বাবার অতি প্রিয় এক বন্ধুকে বিয়ে করেছিল সেই থেকে হয়েছে। বাবা কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। ভাল কথা। আপনি কি আমাদের কয়েকদিন লুকিয়ে থাকার মত কোনো একটা জায়গার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?