ইনটেনসিভ কেয়ার ঘরের সামনে একজন পুলিশও দেখলাম ঘোরাঘুরি করছে। চশমা পরা গুরুগম্ভীর একজনকে দেখা গেল। চৈত্রমাসের এই গরমেও তার গায়ে উলের কোট। শুনলাম। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট। ডেথ বেড় ষ্টেটমেন্ট নিতে এসেছেন। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবকে অত্যন্ত বিরক্ত মনে হল। তিনি তার মতই আরেক গুরু গম্ভীর মানুষকে ভুরু টুরু কুঁচকে হাত পা নেড়ে কী সব বলছেন। আমি কাছে গিয়ে শুনি.ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বলছেনআমি তো সারাদিন এখানে বসে থাকব না। রোগীর যদি জ্ঞান ফেরে আমাকে খবর দিলে আমি চলে আসব। আর ধরেন ইন কেইস যদি জ্ঞান না ফেরে— ডাক্তারের কাছে রোগী যে কথা বলেছে সেটাকেই স্টেটমেন্ট হিসেবে নেয়া হবে। রোগী ডাক্তারকে কী বলেছে তা একটা কাগজে লিখে সই করে দিতে বলুন।
যাকে এই কথা বলা হল তিনি মহাবিরক্ত হয়ে বললেন, আমি বলব কেন? আপনি বলুন। এটা আপনার জুরিসডিকশান।
ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আমার জুরিসডিকশান হবে কেন?
আচ্ছা ফাইন, আপনার জুরিসডিকশান না। আপনি চিৎকার করছেন কেন? Why you are raising your voice.
ভয়েস আমি রেইজ করছি না আপনি করছেন?
আপনি শুধু যে ভয়েস রেইজ করছেন তা না, আপনি মুখ দিয়ে থুথুও ছিটাচ্ছেন।
দুজনের কথা কাটাকাটি শুনতে অনেকেই জুটে গেল। সবাই মজা পাচ্ছে। আমিও পাচ্ছি, অপেক্ষা করছি ঝগড়াটা কোথায় থামে সেটা দেখার জন্যে। ঝগড়া থামতে হলে একজনকে পরাজয় স্বীকার করতে হবে। পরাজয়টা কে স্বীকার করে সেটাই দেখার ইচ্ছ। আমার ধারণা ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব পরাজয় স্বীকার করবেন। চিৎকার উনিই বেশি করছেন। দম ফুরিয়ে যাবার কথা।
পেছন থেকে আমার পাঞ্জাবি ধরে কে যেন টানল। আমি ফিরে দেখি চন্দ্র চাচী। অনেক দূরের লতায় পাতায় চাচী। বিবাহ এবং মৃত্যু এই দুই বিশেষ দিনে লতা–পাতা আত্মীয়দের দেখা যায়। সামাজিক মেলামেশা হয়। আন্তরিক আলাপ আলোচনা হয়।
চন্দ্রা চাচী বিস্মিত হয়ে বললেন–তুই এখানে কেন? আরেফিন সাহেব তোর কে হয়?
আমি বললাম, আরেফিন সাহেব আমার কেউ হন না তার স্ত্রী আমার খালা হন।
ও আচ্ছা। আমি জানতামই না। কী রকম দুঃখের ব্যাপার দেখেছিস। দিনে দুপুরে জোড়া খুন।
জোড়াখুন বলতে পার না— একজন তো এখনো ঝুলছে।
চাচী দুঃখিত গলায় বললেন–একটা মানুষ মারা যাচ্ছে আর তুই তার সম্পর্কে এমন ডিসরেসপেক্ট নিয়ে কথা বলছিস। এটা ঠিক না। স্বভাবটা বদলা হিমু।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, জ্বি আচ্ছা বদলাব।
কেমন যেন মেকানিক্যাল হয়ে যাচ্ছে। রোবট টাইপ। মানুষের মৃত্যু, রোগ ব্যাধি এই সব কিছুই আর কাউকে স্পর্শ করছে না। ঠিক বলছি না?
অবশ্যই ঠিক বলেছেন।
চন্দ্ৰা চাচী হাত ব্যাগ থেকে পান বের করে মুখে দিতে দিতে চট করে প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন— আমার ছোট মেয়ে ঝুমুর বিয়ে দিয়েছি। সেনাকুঞ্জে অনুষ্ঠান করেছি— গেস্ট ছিল একহাজার।
বল কী?
তাও তো সবাইকে বলতে পারিনি। তোকে অবশ্যই কার্ড পাঠাতাম। তুই কোথায় থাকিস জানি না।
বিয়ে ভাল হয়েছে কি না বল। ছেলে কেমন হীরের টুকরা না গোবরের টুকরা?
চন্দ্ৰা চাচী চোখ মুখ শক্ত করে বললেন— ছেলে গোবরের টুকরা হবে কেন? এই সব কী ধরনের কথা? ছেলে কেমিক্যাল ইনজিনিয়ারিং–এ পি, এইচ. ডি. করেছে। আমেরিকায় থাকে। ছেলের আপনি চাচা ষ্টেট মিনিস্টার।
বলো কি? মিনিস্টারের ভাতিজা?
ছেলের ফ্যামিলি খুবই পলিটিক্যাল। এবং খানদানী পলিটিক্স করে। এখনকার কাদা ছোড়াছড়ি পলিটিক্স না। ছেলের বড় দাদা বৃটিশ আমলের এম. এল.এ ছিলেন।
আশ্চর্য তো।
চন্দ্র চাচী আনন্দিত গলায় বললেন, ঝুমুর বিয়েতে মন্ত্রীই এসেছিল চারজন। বাংলাদেশের অনেক ইম্পটেন্ট কবি সাহিত্যিকেরা এসেছিলেন। শো বিজনেসের অনেকেই ছিল। ফিল্মের দুই নায়িকা এসেছিল। তারপর টিভির নায়িকারাও ছিল। অটোগ্রাফের জন্যে এমন হুড়াহুড়ি শুরু হল। সব ভিডিও করা আছে। বাসায় আসিস দেখাব।
আচ্ছা যাব একদিন।
আজই চল না। টোটাল চার ঘন্টা ভিডিও ছিল কেটে কুটে দুঘন্টা করা হয়েছে। এর মধ্যে আবার বাইরে থেকে মিউজিক পাঞ্চ করা হয়েছে বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই জায়গামত বসানো হয়েছে। মিউজিকটা সামান্য sad হয়েছে। তবে তুই দেখে খুবই মজা পাবি।
শুনেই আমার মজা লাগছে। বিয়ের দিন ঝুমুকে কী সুন্দর যে লাগছিল। না দেখলে বিশ্বাস করবি না। এর কারণও আছে— ঝুমুরের মেকাপ দেয়ার জন্যে আমি ফিল্ম লাইন থেকে মেকাপম্যান নিয়ে এসেছি। দীপক কুমার শুর, দুবার মেকাপে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া মেকাপম্যান। সে তিনঘন্টা লাগিয়ে মেকাপ দিয়েছে। ফিল্ম লাইনের মেকাপম্যানরা মুখের কাটা ভাঙতে পারে। ঝুমুরের থুতনী সামান্য উঁচু ছিল না? এটা এমন করেছে…
দাবিয়ে দিয়েছে?
হুঁ। আয়নায় ঝুমু নিজেকে দেখে চিনতে পারেনি।
দাঁতের কী করেছে?
চন্দ্রা চাচী বিস্মিত হয়ে তাকালেন। আমি বললাম, ঝুমুর সামনে কোদাল সাইজের যে দুটা দাঁত ছিল তার কী করা হয়েছে? সেগুলিও কি দাবিয়ে দেয়া হয়েছে?
চন্দ্ৰা চাচী থমথমে গলায় বললেন, ঝুমুর কোদাল সাইজ দাঁত?
আমি হাই চাপতে–চাপতে বললাম, ভুলে গেছ না-কি, ঝুমুকে স্কুলের বন্ধুরা মিকি মাউস বলে ক্ষেপাত। সে বাসায় ফিরে কাঁদত। ঐ দাঁত দুটার কি হল? ফিল্ম লাইনে মেকাপ দিয়ে বড় দাঁত ছোট করার ব্যবস্থা-কি কিছু আছে?