আমরা হাজত থেকে বের হয়ে এলাম। ওসি সাহেব বললেন, এ্যামেচার মাের্ডারার। হাদি আপনার খালার ঢাকার বিষয় সম্পত্তির লোভে খুনটা করেছে। ক্যালকুলেশনস ছিল পুওর। ভজঘট করে ফেলেছে। বড় ক্রাইমের ক্রিমিন্যাল সব সময় ধরা পড়ে যায়। ক্রাইমে সে কিছু–না-কিছু খুঁত রেখে যায়। নিজের কিছু চিহ্ন রাখে। একমাত্র পুলিশই পারে কোনো রকম খুঁত ছাড়া ক্রাইম করতে। কারণ তারা খুঁতগুলি জানে।
স্যার আপনার কথা শুনে ভাল লাগছে।
ভাল লাগার মত কী কথা বললাম। ভাল লাগার মত আমি কিছুই বলিনি। আপনি আপনার স্বভাবমত আমাকে নিয়ে ফান করার চেষ্টা করছেন। দয়া করে করবেন না।
জি আচ্ছ। আমি কি চলে যাব, না থাকব?
তদন্তের স্বার্থে আমার উচিত আপনাকে থানায় আটকে রাখা। কিন্তু আমার উপর নির্দেশ আছে আপনাকে ছেড়ে দেয়ার।
নির্দেশটা কে দিয়েছেন? জুঁই-এর বাবা?
হ্যা স্যারের নির্দেশ।
জুঁই-এর এখনো কোনো খবর পাওয়া যায়নি?
আমি জানি না।
আমি কি টেলিফোনে একটু খোঁজ নিয়ে দেখব?
রকিবউদ্দিন সাহেব কিছুক্ষণ ভাবলেন তারপর টেলিফোন সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি আমার মোবাইলে টেলিফোন করলাম। সঙ্গে সঙ্গেই জুঁই-এর বাবার গলা শোনা গেল। তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বললেন, হ্যালো হ্যালো। কে বলছেন?
স্যার আমি হিমু।
ও তুমি।
জুঁই-এর কি কোনো খবর পাওয়া গেছে?
না।
টেলিফোন করেনি?
না।
আধ্যাত্মিক লাইনে চেষ্টা চালালে কেমন হয়। স্যার?
তার মানে?
খুবই উচ্চশ্রেণীর এক সাধক ধানমন্ডি থানা হাজতে আছেন। তার নাম মুসলেম মিয়া। তবে এই নামে কেউ তাকে ডাকে না। এতে বেয়াদবী হয় এই জন্যেই। কেউ–কেউ তাকে ডাকেন নাঙ্গু বাবা, কারণ তিনি নগ্ন থাকেন। আবার কেউ–কেউ ডাকেন। বেলী বাবা। কারণ উনি সব সময় বেলী ফুলের মালা গলায় দিয়ে থাকেন। অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন স্যারশীত কালে যখন বেলী ফুলের সিজন না, তখনো তাঁর গলায় টাটকা বেলী ফুলের মালা দেখা যায়। বাবার কাছে একবার গিয়ে দেখলে হত।
আমি কি করব না করব তা আমি ঠিক করব। তোমাকে ভাবতে হবে না।
জি আচ্ছা।
তুমি কোথেকে কথা বলছ?
থানা থেকে। আমার এক খালা খুন হয়েছেন। পুলিশ এই জন্যে আমাকে ধরে নিয়ে এসেছে। তবে ওসি সাহেব বলেছেন, ছেড়ে দেবেন।
তুমি আর কিছু বলবে না-কি অর্থহীন বক বক করবে? যদি গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা না–থাকে তাহলে টেলিফোনটা রাখা। আমি এই টেলিফোনের লাইনটা সব সময় খোলা রাখতে চাই।
জি আচ্ছা স্যার।
আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। ওসি সাহেবের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে পথে নামলাম।
আজ সারাদিনে কোথায়–কোথায় যাব ঠিক করা দরকার। মালিহা খালার বাড়িতে যাব না। মৃত মানুষকে দেখতে যাওয়া অর্থহীন। এখানে দেখাটা হয় একতরফা। একজন দেখে–অন্যজন তাকিয়ে থাকে, দেখে না।
আরেফিন খালু সাহেবকে অবশ্যই দেখতে যাব। জীবন–মৃত্যুর মাঝখানে যারা থাকে তাদের দেখতে বড় ভাল লাগে। এরা তখন অদ্ভুতঅদ্ভুত কথা বলে। একজনকে পেয়েছিলাম যে বারবারই বিস্মিত হয়ে বলছিল–বেহেশত দেখতে পাইতেছি। আচানক বিষয় বেহেশত দেখতেছি। ও আল্লা একটা বাগান। বাগানটা পানির মধ্যে। কী সুন্দর টলটিলা পানি। পানির মধ্যে এইটা কী আচানক বাগান। ঘর বাড়ি আছে— পানির রং বদলাইতেছে–ও আল্লা, বাগানের গাছগুলান হাসে। গাছ মানুষের মত হাসে। গাছগুলা আবার এক জায়গা থাইক্যা আরেক জায়গায় যায়… এইটা কি পানির মধ্যে পাখি উড়তাছে!!…
হাদি সাহেবের কন্যা পাখির সঙ্গেও দেখা করা দরকার। বেচারীর জন্মদিন যেন ভেস্তে না যায়। সার্কাস পাটিরও খোেজ নেয়া দরকার। কারো কাছে যদি হাতির বাচ্চা থাকে তা হলে একদিনের জন্যে ভাড়া করতে চাই। কে জানে একদিনের ভাড়া কত?
আজ আকাশ মেঘমেদুর। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। এক পশলা বৃষ্টি মনে হয় হয়েছে। পিচ ঢালা রাজপথ বৃষ্টির পানিতে ভেজা। রূপার পাতের মত চক চক করছে। রাস্তাগুলিতে নদী–নদী ভাব চলে এসেছে।
ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট
আরেফিন খালু সাহেবকে রাখা হয়েছে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে।
তাঁর নাকে মুখে নল। বিছানার পাশে স্যালাইনের বোতল ঝুলছে। মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ। একটা চোখ বের হয়ে আছে। সেই চোখের পাতা নামানো। ভাল করে দেখার আগেই পুরুষ টাইপ এক মহিলা নার্স— বের হন, বের হন বলে সবাইকে বের করে দিল। খালু সাহেবের আত্মীয়–স্বজনে হাসপাতাল গিজগিজ করছে। হাসপাতালের ডাক্তার ছাড়াও বাইরের ডাক্তারাও এসেছেন। মেডিক্যাল বোর্ড বসেছে। ডাক্তারদের আলাপ আলোচনায় যা জানা গেল তার সারমর্ম হল–রোগী ডীপ কোমায় চলে গেছে। কোনো মিরাকল না–ঘটলে বাঁচবে না। আরেফিন খালুর আত্মীয়স্বজনদের আলোচনায় জানা গেল ডীপ কোমায় যাবার আগে ডাক্তার, নার্স এবং তাঁর দূর সম্পর্কের এক ভাই-এর কাছে হত্যাকান্ডের বর্ণনা দিয়ে গেছেন। তিনি ঘুমুচ্ছিলেন বসার ঘরের ড্রয়িং রুমে। তাঁর স্ত্রী দরজা বন্ধ করে ঘুমুচ্ছিলেন শোবার ঘরে। তিনি নিজে অনেক রাত জেগে মদ্যপান করছিলেন বলে শেষ রাতের দিকে তাঁর গাঢ় ঘুম হয়। হঠাৎ ধ্বস্তাধস্তি এবং চিৎকারের শব্দ তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি চমকে উঠে বসেন এবং দেখেন তাঁর বাড়ির কেয়ারটেকারের সঙ্গে তার স্ত্রী ধস্তাধস্তি করছেন। তাঁর স্ত্রীর শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তিনি স্ত্রীকে রক্ষার জন্যে ছুটে যান। তারপর কী হয় তা তার মনে নেই।