সে কি এই হাজতেই আছে?
না। উনি আছেন ধানমণ্ডি থানায়।
ওসি সাহেব আমার দিকে আরো খানিকটা ঝুকে এসে গলা নামিয়ে ফিলফিস করে বললেন, খুবই স্ট্রেঞ্জ একটা ঘটনা। আপনাকে না বলেও পারছি না। ধানমন্ডি থানায় ওসি সাহেবের এক শালী।–মেনস্ট্রেশন টাইমে তার প্রচণ্ড ব্যথা হয়। মাঝে মধ্যে অজ্ঞানও হয়ে যায়। তার ব্যথা উঠেছে ওসি সাহেব কি মনে করে মুসলেম সাহেবকে ঘটনাটা বললেন। শুনেই মুসলেম সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই মেয়ের ব্যথা চলে গেল।
ও।
এই ভাবে ও বললেন কেন? বিশ্বাস হচ্ছে না। ধানমন্ডি থানার ওসি সাহেব নিজের মুখে ঘটনাটা আমাকে বলেছেন।
আমরা কি মুসলেম মিয়াকে নিয়েই কথা বলব?
অবশ্যই না। আসুন যে জন্যে ডেকেছি। এটা শেষ করি তারপর আপনাকে নিয়ে মুসলেম সাহেবের কাছে যাব। আপনার সঙ্গে পরিচয় কেমন?
খুবই খারাপ ধরনের পরিচয়। আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না। একবার দাঁত–টাত বের করে কামড়াতে এসেছিল।
তা হলে থাক। এই ধরনের মানুষ অবশ্যি খুব সামান্যতেই ভায়োলেন্ট হন। এদের ঘাটাতে নেই। আচ্ছা এখন আসল কাজে আসি। তার আগে আর এককাপ চ খেয়ে নেবেন।
জ্বি না।
কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দেবেন। মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না। অনুমানে কিছু বলবেন না। প্রশ্নের উত্তর যদি জানা না থাকে বলবেন জানি না।
জ্বি আচ্ছা।
হাদিকে চেনেন?
একজনকে চিনি। হাদিউজ্জামান খান তক্ষকের মত মুখ। লম্বা।
তার চেহারার বর্ণনা দিতে তো আপনাকে বলিনি। তাকে চেনেন কি না জানতে চেয়েছি।
চিনি।
তার সঙ্গে শেষ দেখা করে হয়েছে?
গত পরশু।
কী কথা হয়েছে?
কোনো কথা হয়নি।
তাকে চেনেন। অথচ কথা হয়নি কেন?
মালিহা খালার বাড়িতে উনি ফ্যান নামাতে গেছেন। কাজে ব্যস্ত ছিলেন বলে কথা হয়নি।
ফ্যান কি একা একা নামাচ্ছিল না। সঙ্গে কেউ ছিল?
একজন ইলেকট্রিক মিস্ত্রী ছিল।
ইলেকট্রিক মিস্ত্রীর নাম?
নাম জানি না। ইলেকট্রিক মিস্ত্রী বা কল সারাই মিস্ত্রী, কিংবা টেলিফোনের মিস্ত্রী–এদের নাম সাধারণত জিজ্ঞেস করা হয় না।
যে ইলেকট্রিক মিস্ত্রীকে হাদিউজামানের সঙ্গে দেখেছিলেন তাকে দেখলে চিনতে পারবেন?
হ্যাঁ পারব।
তা হলে একটু হাজতে আসুন–আইডেনটিফাই করবেন?
ইলেকট্রিক মিস্ত্রী ভয়ংকর কিছু কি করেছে?
সে একা করেনি দুজনে মিলে করেছে। আচমকা খুন একজন করে। কিন্তু ক্যালকুলেটিভ মার্ডারের বেলায় একমপ্লিশ লাগে। খুন করেছে হাদিউজ্জামান, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী সালাম হল তার একমপ্লিশ।।
খুন কে হয়েছে?
মালিহা বেগম। আপনার খালা হন সম্ভবত।
আমি অবাক হয়ে রকিবউদ্দিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার এক আত্মীয় খুন হয়েছে এই খবরটা ওসি সাহেব আমাকে এখন দিচ্ছেন। খুন-টুনের ব্যাপারগুলি পুলিশের কাছে এতই গুরুত্বহীন?
ওসি সাহেব বললেন, আপনার খালার খুন হবার খবর আপনি পাননি?
জ্বি না।
কাগজে উঠেছে তো। কাগজ পড়েননি?
খুন খারাবির নিউজগুলি আমি পড়ি না। এখন মনে হচ্ছে পড়া দরকার। আমার খালু, আরেফিন সাহেব উনি কোথায়?……
উনাকেও খুন করার চেষ্টা হয়েছে। উনি হাসপাতালে আছেন। ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন।
ও আচ্ছা।
ওসি সাহেব বললেন, চলুন তো আমার সঙ্গে সালামকে আইডেনটিফাই করবেন।
হাদি সাহেবও কি হাজতে আছেন?
হ্যাঁ। আছে। তবে জ্ঞান আছে বলে মনে হয় না। যে ডলা খেয়েছে। তার খবর হয়ে গেছে।
হাজাতের মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় দুজনেই পড়ে আছে। মুখ ফুলে এমন হয়েছে যে অতি পরিচিত জনেরও এদেরকে চেনার কথা না। ইলেকট্রিক মিস্ত্রী ছেলেটা পড়ে আছে খালি গায়ে। তার বুক হাপরের মত ওঠানামা করছে। আমি আমার জীবনে কারো বুক এ ভাবে ওঠানামা করতে দেখিনি। একেকবার বুক ফুলে উঠছে আর মনে হচ্ছে ছেলেটার হৃদপিন্ড পােজর ফুড়ে বের হয়ে আসবে।
ওসি সাহেব বললেন, চিনতে পারছেন?
আমি বললাম, না।
হাদিকেও চিনতে পারছেন না?
জ্বি না। যে মার মেরেছেন— মুখ যে ভাবে ফুলেছে আমি কেন পাখি এসেও চিনবে না।
পাখি কে?
পাখি তাঁর মেয়ে। বারো তারিখ মেয়েটার জন্মদিন। আমার দাওয়াত আছে। কোনো কাজ না থাকলে সেদিন আপনিও চলুন।
ওসি সাহেব রাগী গলায় বললেন— আপনার খালা খুন হয়ে গেছেন আর আপনার মাথায় ঘুরছে— জন্মদিনের দাওয়াত? আপনার ফালতু কথা বলার অভ্যাসটা দূর করুন। থানায় এসে একটা বাড়তি কথা বলবেন না।
জ্বি আচ্ছা। আমি কি হাদি সাহেবের সঙ্গে দুটা কথা বলব?
বলুন।
আমি অনেকক্ষণ হাদি সাহেব, হাদি সাহেব বলে ডাকলাম। কেউ জবাব দিল না। অজ্ঞান মানুষ প্রশ্নের জবাব দেয় না। তবে ইলেকট্রিক মিস্ত্রী উঠে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে কী যেন বলল। তার ঠোঁট কেটে দুফাক হয়ে গেছে, দাঁত ভেঙেছে। সে হাত তুলে আমাকে সালামও দিল। মনে হয় আমাকেও পুলিশের কেউ ভেবেছে।
আমি ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি নিশ্চিত যে এরাই খুন করেছে?
ওসি সাহেব বললেন, অবশ্যই। কিছু–কিছু খুনের মিমাংসা অতি দ্রুত হয়ে যায়, আবার কিছু কিছু খুনের মিমাংসাই হয় না। এই ক্ষেত্রে খুনের মিমাংসা দ্রুত হয়ে গেল।
হাদি সাহেব স্বীকার করেছেন যে খুনটা উনি করেছেন?
সে করে নাই। তবে সালাম করেছে। তাকে রাজসাক্ষি করে দেব। ওসি সাহেব সালামের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি রে তুই খুন করেছিস?
সালাম হ্যাঁ–সুচক মাথা নাড়ল। তার কাটা ঠোঁটের কোণায় সামান্য হাসিও দেখা গেল। যেন খুন করে সে আনন্দিত।