প্রতিবেদন পড়ে আমি হিমু কিছুক্ষণ ঝিমু হয়ে বসে রইলাম। পত্রিকাওয়ালারা মুসলেম মিয়াকে নিয়ে যে হৈ চৈ টা করবে তা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। প্রতিবেদনের পর প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে। একদল মানুষের কাছে সে রাতারাতি আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পন্ন সাধক হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে। তাকে নিয়ে নানান ধরনের বিস্ময়কর খবর রটিতে থাকবে। একটা সময়ে রাজনীতিবিদরা, মন্ত্রীরা, বড় বড় আমলারা গভীর রাতে গোপনে গাড়িতে করে তার কাছে আসতে শুরু করবেন। কারণ নেংটি বাবার দোয়া তাদের দরকার।
পুলিশ দুএকদিনের মধ্যে আমাকে এসে ধরে নিয়ে যাবে এই আশঙ্কাও আমি উড়িয়ে দিচ্ছি না। মুসলেম মিয়া আমার নামটা পুলিশের কাছে বললেই আমি ফেঁসে যাব। পুলিশ জোর তদন্ত শুরু করে দেবে। যে–কোনো হাস্যকর ব্যাপারে জোর তদন্ত চালাতে পুলিশ বড়ই ভালবাসে।
আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হতে লাগল— আজই আমাকে পুলিশ ধরবে, ঘন্টা দুতিনেকের মধ্যেই পুলিশের জীপ এসে উপস্থিত হবে। এটাকে সিক্সথ সেন্স বলব কি-না বুঝতে পারাচ্ছি না। সিক্সথ সেন্সই হোক আর সেভেনথ সেন্সই হোক হাজতে যেতে হলে তার জন্যে প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। বাথরুম সারিতে হবে (বড়টা)। হাজতে নেবার সঙ্গে–সঙ্গে প্রথম যে জিনিসটা পায় তার নাম বড় বাথরুম। হাজতে বাথরুমের ব্যবস্থা নেই। বাথরুম পেলে গার্ড পুলিশের কাছে অনেকক্ষণ ধরে হাত কচলাতে হয়, নরম গলায় অনেক আবেদন নিবেদন করতে হয়। গার্ড সাহেবের দয়া হলে হাজাতের ঘর খুলে তিনি বাথরুমে নিয়ে যান।
মাথার চুল কাটতে হবে। সবচে ভাল মাথাটা কামিয়ে ফেললে। চুল বড় বড় থাকলে খুবই গরম লাগে। তারচেয়েও বড় কথা প্রথম রাত কাটিয়ে দ্বিতীয় রাতে পড়লেই মাথা ভর্তি হয়ে যায় উকুনে। উকুনগুলি বাইরে থেকে আসে, না এক রাতেই মাথায় গজায় এই রহস্যের মিমাংসা আমি এখনো করতে পারিনি। হাজাতি–উকুনের আরেকটা মজার ব্যাপারে হচ্ছে, হাজত থেকে ছাড়া পাবার সঙ্গে–সঙ্গে উকুনও চলে যায়। হাজতি–উকুন মনে হয় হাজত ছাড়া অন্য কোনো পরিবেশে বাঁচে না।
আমি হাজত বাসের প্রস্তুতি নিয়ে বড় বাথরুম সারলাম। রাস্তার পাশে ইটালিয়ান সেলুন থেকে তিন টাকা দিয়ে মাথা নেড়া করলাম। নাপিত আবার মাথা নেড়ার পর কিছুক্ষণ মাথা মালিশ করে দিল। যে উৎসাহের সঙ্গে নাপিত মাথা মালিশ করল তাতে মনে হল–মাথা মালিশ করে সে খুবই মজা পেয়েছে।
মেসে ফিরে দেখি পুলিশ এসে গেছে। একজন সাব ইন্সপেক্টর ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে আমার ঘরের সামনে পায়চারি করছেন। তিনি আমাকে দেখেই প্রায় হুঙ্কার দিলেন। ভুল ইংরেজিতে বললেন–You name Himu?
আমি বললাম, ইয়েস স্যার। I name Himu.
তিনি দ্বিতীয়বার হুংকার দিলেন— এবারের হুংকার খাটি বাংলা ভাষায়, চল থানায় চল।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, স্যার চলুন।
থানায় ওসি সাহেব আমার পূর্ব পরিচিত। নাম রকিব উদ্দিন, চাঁদপুরে বাড়ি। বছর দুই আগে তিনি কিছুদিন আমাকে হাজতে রেখেছিলেন। অত্যন্ত উগ্রমেজাজের মানুষ, তবে শেষের দিকে তাঁর সঙ্গে আমার খুবই খাতির হয়ে গিয়েছিল। সেই খাতির এখন কাজ করার কথা না। পুলিশ বড়ই বিস্মরণ প্রিয়। তারা অতীত মনে রাখে না। রকিবউদ্দিন সাহেব মনে রাখবেন সেই আশা আমি করিনি। দেখা গেল। ভদ্রলোকের মনে আছে। আমার দিকে কিছুক্ষণ বিরক্ত চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, বসুন। আমি বসলাম। যে সেকেন্ড অফিসার আমাকে ধরে নিয়ে এসেছেন রকিব উদ্দিন সাহেব তার দিকে তাকিয়ে আগের চেয়েও বিরক্ত গলায় বললেন, হ্যাণ্ডকাফ লাগিয়েছেন কেন? হ্যান্ডকাফ লাগানোর দরকার ছিল না। খুলে দিন।
আমার হ্যান্ডকাফ খুলে দেয়া হল। ওসি সাহেব চা দিতে বললেন।
চা দেয়া হল।
সিগারেটের প্যাকেট এবং দেয়াশলাই আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি সিগারেট ধরালাম।
রকিবউদ্দিন এবার আমার দিকে ঝুকে এসে বললেন, আজই মাথা কামিয়েছেন?
আমি বললাম, জ্বি।
মাথা কামিয়েছেন কেন?
পুলিশের লোকজন সত্যি কথা কখনই গ্ৰহণ করতে পারে না। উদ্ভট মিথ্যা তারা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে। মাথা কেন কামিয়েছি। এই সত্য বলে লাভ হবে না, নানান ভাবে পেঁচাবে। মাথা কামানো নিয়ে ঘন্টা খানিক কথা বলতে হবে তারচে মিথ্যা বলাই ভাল। আমি বললাম, আজ একটি বিশেষ দিন। বৌদ্ধ পূর্ণিমা। এই পূর্ণিমায় মহামতি সিদ্ধাৰ্থ মস্তক মুন্ডন করে গৃহত্যাগ করেন। তাকে স্মরণ করে এই কাজটা করেছি। এখন স্যার বলেন। আপনি কেমন আছেন?
ওসি সাহেব বিরস গলায় বললেন, ভাল আছি।
আমাকে কেন আনিয়েছেন জানতে পারি কি স্যার?
হ্যাঁ জানতে পারেন। কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করব?
মুসলেম মিয়া সম্পর্কে?
কোন মুসলেম মিয়া?
খবরের কাগজে যার নিউজ ছাপা হয়েছে। নাঙ্গু বাবা।
ওসি সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, মুসলেম মিয়াকে চেনেন না-কি?
জি চিনি।
রকিবউদ্দিন সাহেব বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, বলেন কী?
তার গলার আগ্রহ থেকেই বোঝা যাচ্ছে নাঙ্গু বাবা ইতিমধ্যেই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। তাকে নিয়ে গল্প গুজব ছড়াচ্ছে। আমি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললাম, সামান্য পরিচয় আছে।
কোথায় পরিচয়?
আমি রাতে বিরাতে হাঁটি তো। সেখানেই দেখা।
লোকটার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা তো প্ৰচণ্ড।
তাই না-কি?
হ্যা প্রচন্ড। অন্তর্ভেদি দৃষ্টি। যখন তাকায় তখন মনে হয়— মনের ভেতর যা আছে সব পড়ে ফেলেছে। তারপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসে। ঠান্ডা টাইপ হাসি। এরকম হাসি আমি কাউকে হাসতে দেখিনি।