মেয়েটি বলল, আমি অনেকক্ষণ হল রাস্তা ক্রস করার চেষ্টা করছি, পারছি না। অন্যদিন ট্রাফিক পুলিশ থাকে। আজ ট্রাফিক পুলিশও নেই। আপনি কি রাস্তা ক্রস করার ব্যাপারে আমাকে একটু সাহায্য করবেন?
আমি দেখি কী করা যায় বলেই ঝাঁপ দিয়ে দুহাত উঁচু করে রাস্তার মাঝখানে পড়ে গেলাম। সেইসঙ্গে বিকট চিৎকার— ট্রাফিক বন্ধ, ট্রাফিক বন্ধ। চাক্কা ঘুরবে না।
নিমিষের মধ্যে ব্রেক কষে সব গাড়ি থেমে গেল। রিকশাওয়ালারা দাঁড়িয়ে পড়ল। গাড়ির ড্রাইভাররা মুখ বের করে আতঙ্কিত ভঙ্গিতে দেখতে চেষ্টা করল কী হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে টোকাইরা খুব মজা পায়। তারাও লাফ দিয়ে রাস্তায় নামল। এবং আমার মতোই হাত উঁচু করে গাড়ি আটকাতে লাগল। একজন অতি উৎসাহী ছুটে গিয়ে পর পর দুটা রিকশার পাম ছেড়ে দিল। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা করলাম রাস্তা পার হতে। সে রাস্তা পার হল।
ইতিমধ্যে রাস্তায় জট পাকিয়ে গেছে। একটা গাড়ির ড্রাইভার ভয় পেয়ে গাড়ি উল্টোদিকে নেবার চেষ্টা করতে গিয়ে পুরোপুরি গিট্টু পাকিয়ে ফেলেছে। এই গিট্টু আপনা-আপনি খুলবে না। গিট্টু খুলতে এক্সপার্ট ট্রাফিক সার্জেন্ট লাগবে। সে এসে বেশ কিছু রিকশাওয়ালাকে মারধোর করবে–তারপর যদি কিছু হয়।
আমি তরুণীকে বললাম, আর কোনো সাহায্য লাগবে? আমি ধরেই নিয়েছিলাম মেয়েটি না–সূচক মাথা নাড়বে। সামান্য রাস্তা পার করাতে যে এত যন্ত্রণা করে তার ওপর ভরসা করা যায় না।
মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আরেকটু ফাউ সাহায্য করতে পারেন। আমাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে পারেন। একটা লোক আমাকে ফলো করছে। আমার ভালো লাগছে না।
কে ফলো করছে?
গলায় হলুদ মাফলারওয়ালা একটা লোক। আমি যখন ইস্টার্ন প্লাজায় ছিলাম তখনো আমার পেছনে পেছনে ঘুরেছে। এখনো দেখি পেছনে পেছনে আসছে।
প্যাঁচ লাগিয়ে দেব?
প্যাঁচ লাগাতে হবে না। দয়া করে আমার পেছনে পেছনে এলেই হবে।
আমি নিতান্ত অনুগতের মতো তার পেছনে পেছনে যাচ্ছি। মেয়েটি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, ভালো কথা। আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না কেন?
আমি হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, চিনতে পারার কথা?
অবশ্যই। আমি সীমার বান্ধবী।
সীমাটা কে?
সীমাটা কে মানে? সীমা আপনার মামাতো বোন। গত মাসে বিয়ে করেছে। কোর্টে গিয়ে গোপন বিয়ে। আপনি সেই বিয়েতে সাক্ষী ছিলেন।
ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে। তুমিও ছিলে সেই বিয়েতে?
হ্যাঁ ছিলাম। এবং আপনি সেদিন আমার সঙ্গে অনেক গল্প করেছিলেন।
ও আচ্ছা।
সেদিন আমি সোনালি ফ্রেমের চশমা পরেছিলাম। আপনি বলেছিলেন, রুপালি ফ্রেমের চশমা হলে আমাকে খুব মানাত। আমার মুখটা না-কি তৈরিই হয়েছে রুপালি ফ্রেমের জন্যে। আমি আপনার কথামতো রুপালি ফ্রেম কিনেছি।
ও আচ্ছা।
আপনি আমাকে না চিনেই লাফালাফি করে গাড়ি থামালেন। আশ্চর্য তো। অন্য কোনো মেয়ে যদি আপনাকে রাস্তা পার করাতে বলতে আপনি কি এরকম লাফালাফি করতেন?
বুঝতে পারছি না।
আমার মনে হয় করতেন। আমার নাম কি আপনার মনে আছে?
অবশ্যই মনে আছে। তবে মনে থাকলেও মন থেকে টেনে মুখে আনতে একটু সমস্যা হচ্ছে। ফুলের নামে নাম। হয়েছে?
বলুন কী ফুল।
প্রচুর গন্ধ আছে এমন একটা ফুল। রাতে ফোটে। মনে পড়েছে। তোমার নাম জুঁই।
কিছুই হয়নি। আমার নাম আঁখি।
ও আচ্ছা, আঁখি।
মেয়েটি তার গাড়ি খুঁজে পেয়েছে। কালো রঙের বিশাল এক গাড়ি। গাড়ির মতো গাড়ির ড্রাইভারও বিশাল। ড্রাইভার সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে দেখে ভালো লাগল। মানুষের সন্দেহের দৃষ্টিতে এমন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে কেউ স্বাভাবিক দৃষ্টিতে তাকালে ধাক্কার মতো লাগে। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালে মনে হয় সব ঠিক আছে।
আঁখি বরফ শীতল গলায় বলল, গাড়িতে উঠুন।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আমাকে গাড়িতে উঠতে বলছ!
হ্যাঁ।
কেন বলো তো?
আগে গাড়িতে উঠুন। তারপর বলছি।
আমি গাড়িতে উঠে পড়লাম। আঁখি বলল, সহজে আমার মন খারাপ হয় না। আপনি আমাকে চিনতে পারেননি এইজন্যে মন খারাপ লাগছে। যে মেয়ে আপনার সামান্য কথায় চশমার ফ্রেম বদলে ফেলে আপনি তাকে চিনবেন না, এটা কেমন কথা?
বিশালদেহী ড্রাইভার গাড়ির ব্যাক ভিউ মিরার নাড়াল। আমি এখন সেই আয়নায় ড্রাইভারের মুখ দেখতে পাচ্ছি। কাজেই সেও নিশ্চয়ই আমাকে দেখছে। ড্রাইভার কাজটা করেছে আমাকে চোখে-চোখে রাখার জন্যে। গাড়ি চলতে শুরু করল।
আঁখি বলল, দয়া করে পেছনে ফিরে দেখুন তো লাল রঙের কোনো গাড়ি আমাদের ফলো করছে কি-না।
আমি বললাম, না।
এখন না করলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখবেন ঐ গাড়ি আমাদের পেছনে চলে এসেছে। জানা কথা আসবে।
আমি পেছন দিকে তাকিয়ে আছি। আঁখি বলল, এই ভাবে পেছন দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হবে না। গাড়ি আসুক পেছনে–পেছনে। আপনি সোজা হয়ে বসুন।
আমি সোজা হয়ে বসলাম।
আমার সঙ্গে গাড়িতে যেতে আপনার কি অস্বস্তি লাগছে?
না।
তাহলে চুপ করে আছেন কেন, গল্প করুন।
গল্প তো জানি না।
কথা বলুন।
কথাও জানি না।
আমার বান্ধবীর বিয়ের দিন মজার মজার কথা বলছিলেন। আমি এমন সমস্যায় পড়েছিলাম, হাসতেও পারছিলাম না। আবার না-হোসেও থাকতে পারছিলাম না।
হাসতে পারছিলে না কেন?
শীতের সময় তো, এইজন্যে হাসতে পারিনি।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, শীতের সময় হাসা যায় না?
আঁখি বলল, অন্য সবাই হাসতে পারে। আমি পারি না। আমার গায়ের চামড়া খুব খারাপ। শীতের সময় ঠোঁট ফাটে। ঠোঁট ফাটা অবস্থায় হাসার চেষ্টা করে দেখবেন তাহলে আমার সমস্যাটা বুঝবেন।